পুরনো পুরভবন (বাঁ দিকে) এবং শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন (ডান দিকে)। ছবি সংগৃহীত।
দেড়শো বছরে পা রাখল গোবরডাঙা পুরসভা। প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮৭০-এর ২৬ এপ্রিল। পুরসভার প্রথম নির্বাচিত পুরপ্রধান ছিলেন শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। বিদ্যাসাগরের এই প্রিয়পাত্র প্রথম বিধবাবিবাহ করেন। রাজ্যের অন্যতম পুরনো এই পুরসভা অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। তার বর্তমানও নানা ভাবে গৌরবের।
পুরসভা স্থাপনের আগে এই জনপদের জনসংখ্যা ছিল ৩ থেকে ৪ হাজারের মধ্যে। পরবর্তী কালে ম্যালেরিয়ার ভয়াবহ প্রকোপে গোবরডাঙা আক্রান্ত হয়। কিছু অধিবাসী কলকাতায় স্থানান্তরিত হন। ১৮৮৩ সালে গোবরডাঙা রেলস্টেশন স্থাপিত হলে জনজীবনে ধীরে হলেও আধুনিকতার নানা বিবর্তন শুরু হয়। বর্তমানে এই জনপদের জনসংখ্যা প্রায় ৪৬ হাজার। এখানে এখনও কিছু গ্রামীণ ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসেও রয়ে গিয়েছে কিছু আমবাগান, লিচু, কাঁঠাল, জাম, জামরুল, নারকেল, সুপারিবাগান।
পুরনো আমলের গোবরডাঙায় জলনিকাশী ব্যবস্থা তুলনায় ভাল ছিল। যমুনা ছিল স্রোতস্বিনী তখন। কঙ্কণা-বাঁওড়-রত্নাখালও ছিল সজীব। দেশভাগের পর বহু ছিন্নমূল মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে গোবরডাঙায় বসত শুরু করেন। শুরু হল খাল-বিল-পুকুর-জলাশয় ভরাট করে হাট-বাজার-দোকান-বসতি স্থাপনের অপরিকল্পিত নয়া উদ্যোগ। ক্রমশ যমুনা ক্ষীণকায়া হতে হতে আজ মৃতপ্রায় বলব, না কি মৃত বলব, সে প্রশ্ন মনে আসবেই। একদা ‘লিঙ্ক রিভার’ হিসেবে বাংলার দূরবর্তী অংশের (যশোহর, খুলনা ইত্যাদি) মানুষেরা নৌকায় যমুনা নদী ব্যবহার করে কাঁচড়াপাড়ার গঙ্গায় প্রবেশ করে দেশের যে কোনও স্থানে যেতে পারতেন। রেল ব্যবহার এই প্রয়োজনকে নিষ্ক্রিয় করে (পড়ুন অপ্রাসঙ্গিক)।
প্রথম দিকে পুরসভার নির্বাচনে একমাত্র নিয়মিত করদাতারা অংশগ্রহণ করতে পারতেন। তখন পুরসভার পাঁচটি ওয়ার্ড ছিল। এখন ১৭টি। পুরসভার প্রথম নির্বাচন হয় ১৮৮৫ সালে। তার আগে অবধি সরকার কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তিদের দ্বারাই পুরবোর্ড গঠন করা হত। প্রথম নির্বাচিত পুরপ্রধান হলেন শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। দেড়শো বছরের এই পুরসভাকে নিয়ে আজ অবধি কোনও ইতিহাসগ্রন্থ রচিত না হওয়াটা গভীর আক্ষেপের।
পুরসভার অন্তর্গত গৈপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন খ্যাতনামা ভূতত্ত্ববিজ্ঞানী প্রমথনাথ বসু। প্রথম বিধবা বিবাহকারী হিসেবে বিদ্যাসাগরের প্রিয় পাত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন (বিবাহের দিন ০৭/১২/১৮৫৬) নামটি সবিশেষ পরিচিত। খাঁটুরা গ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার টোল, চতুষ্পাঠী, কবিরাজী চিকিৎসায়, কথকতা ও বিদ্যাচর্চার জন্য গোটা বাংলায় প্রসিদ্ধ ছিল। সাহিত্যিক প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, চিত্রশিল্পী ভাস্কর হাসিরাশি দেবী, অনিলকুমার ঘোষ, শচীন্দ্রকুমার ঘোষ, ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ গোবরডাঙার সাহিত্যচর্চা, কৃষ্টি, সংস্কৃতচর্চায় প্রভূত অবদান রেখেছেন। বিগত শতাব্দীর চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকের কৃষক আন্দোলন (বাদে খাঁটুরা এলাকায়) একটি সাড়া জাগানো গণজাগরণ প্রয়াসের অন্তর্গত।
জমিদারবাড়ির সিংহদুয়ার
শিক্ষাজগতের বিবিধ কর্মপ্রয়াসে প্রথম উচ্চারিত নামটি এক জন মহিলার— বিনোদিনী সেন। খাঁটুরা গ্রামে প্রতিষ্ঠিত চতুষ্পাঠীয় শিক্ষার বেতন দান, বর্তমানের গোবরডাঙা-খাটুরা হাইস্কুলের জমিতে ১৮৫৫ সালের ৯ অগস্ট খাঁটুরা আদর্শ বঙ্গ বিদ্যালয় স্থাপনায় শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের সহায়তায় তাঁর একটি মহৎ কীর্তি। শোনা যায়, স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয় ওই দিন গোবরডাঙায় এসেছিলেন। ১৮৫৬ সালে গোবরডাঙায় প্রতিষ্ঠিত হয় গোবরডাঙা হাই ইংলিশ স্কুল। জমিদার সারদাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে। নানা কারণে পরবর্তী কালে দু’টি বিদ্যালয় একত্রিত হয়ে (অ্যামালগ্যামেটেড) একটি বিদ্যালয় হিসেবে ১৯৩৫ থেকে কার্য়ারম্ভ করে। ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গোবরডাঙা হিন্দু কলেজ। বাহ্মসমাজ আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ক্ষেত্রমোহন দত্ত, লক্ষ্মণচন্দ্র আশ ও কুমদবিহারী রায় গোবরডাঙায় উদার প্রগতিশীল আধুনিক চিন্তার বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।
বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থান ধূলিসাৎ, যেমন ব্রাহ্মমন্দির, নীলকুঠি ইত্যাদি। গোবরডাঙা নাটকের শহর হিসাবে গোটা পশ্চিমবাংলায় সুপরিচিত। তিরিশের বেশি নাট্যদল সারা বছর সক্রিয়, সামগ্রিক খেলাধুলা ব্যাপারটা তুলনায় নিষ্প্রভ। নাট্যকার কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের লেখা নাটক পশ্চিমবঙ্গের অনেক বড়ো দলের অভিনয়ে আদৃত।
শিক্ষাক্ষেত্রে আধুনিকতায় গোবরডাঙা পিছিয়ে পড়েছে। একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, মেডিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ভোকেশনাল কলেজ দরকার ছিল। এ নিয়ে কোনও ভাবনাচিন্তা বা উদ্যোগ চোখে পড়ে না।
স্বাস্থ্যব্যবস্থা সর্বত্র যেমন, এখানেও তেমন ব্যবসাকেন্দ্রিক। বাইরে থেকে আসা ডাক্তারবাবুরাই (সপ্তাহে একদিন) ভরসা, সর্ববিধ পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও গোবরডাঙা গ্রামীণ হাসপাতাল দীর্ঘকাল বন্ধ থাকা গোবরডাঙার মানুষের কাছে এক গুরুতর অভিশাপ। কোনও রকম নাগরিক আন্দোলন করেও অবস্থার সুরাহা হয়নি। পৌর এলাকায় কৃষিজমি নেই বললেই চলে।
জনজীবনে আধুনিক পরিবহনের গুরুত্ব সব থেকে বেশি। ভিড়ে ঠাসা ট্রেনে যাতায়াত এক অবর্ণনীয় ক্লেশের বিষয়। স্থানীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির ভাবনাও নজরে পড়ে না। পুরনো মান্ধাতা আমলের অপরিসর সরু রাস্তা পিচ ঢেলে চলাচলের সুবিধার চেষ্টা নজরে পড়ে। সকালের দিকে ট্রাফিক জ্যাম অত্যন্ত দুর্ভোগের। রাস্তা চওড়া করা জরুরি। গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় রাস্তায় বেদখল দোকানের রমরমায়। স্টেশন এলাকায় হাঁটাচলা দায়। সকালের দিকে ট্রাফিক জ্যাম এক নিত্য দুর্ভোগ। রাস্তা চওড়া না হলে আগামী দিনে নাগরিক দুর্ভোগ চরমে উঠবে। গোবরডাঙায় প্রধান যে দু’টি বাজার রয়েছে, তার আধুনিকীকরণ হলে অনেক নতুন দোকান গড়ে উঠবে। হকার পুনর্বাসনের সুযোগের সদ্ব্যবহার হচ্ছে না, তেমনই ভ্যান (দু’ প্রকার), টোটো, অটো, বাস, চার চাকার গাড়ি, লরি এসব কোথায় দাঁড়াবে (স্ট্যান্ড) সেবিষয়ে নজর দেওয়া জরুরি।
গত দু’দশকে গোবরডাঙায় পাকা পয়ঃপ্রণালী তৈরির কাজ জোরকদমে চলছে। কিন্তু তার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ বেশ কঠিন কাজ। বাড়ির আবর্জনা বাঁশি বাজিয়ে সংগ্রহ হচ্ছে। কিন্তু আরও ‘ভ্যাট’ থাকা দরকার। দরিদ্র মানুষদের বাড়ি তৈরির প্রকল্পে প্রায় দেড় হাজার গৃহ এ পর্যন্ত নির্মিত। আরও নির্মীয়মাণ।
গোবরডাঙা পুরসভা শান্ত বাসোপযোগী সাংস্কৃতিক শহর হিসেবে সুপরিচিত। নাট্যচর্চার পাশাপাশি সঙ্গীত-নৃত্য-সাহিত্যচর্চা ব্রাত্য নয়। লোক উৎসব, গোবরডাঙা উৎসব, বইমেলা, বিজ্ঞান ও পরিবেশ নির্ভর জনবিজ্ঞান প্রয়াস, বিবিধ সাংস্কৃতিক উৎসব বহাল তবিয়তে চালু আছে।
ভোটের বাজার এখানে কখনও গরম নয়। সব রাজনৈতিক দল নিজেদের সীমা বিষয়ে সচেতন। যশোহর রোড থেকে এগারো কিমি দূরে হওয়ার সুবিধা এটাই। অসুবিধা যে নেই, তা নয়। সরাসরি কলকাতার যোগাযোগ ট্রেন ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। উন্নয়ন যা হয় তা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া। নিজেদের মাস্টার প্ল্যান থাকার ভাবনা কখনও উচ্চারিত নয়। আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জলের সুরাহা এখনও অধরা। বোতল জল (২০ লিটার) প্রায় বাড়িতেই। বৃষ্টির জল সংরক্ষণের কোন কার্যকরী সচেতনতা নেই। যত্রতত্র প্রাচীন ও নবীন গাছ কাটা চলছে অবাধে।
লেখক গোবরডাঙা গবেষণা পরিষৎ-এর কর্ণধার