কৃষ্ণনগর, করিমপুর ও বহরমপুরের বিভিন্ন জায়গায় ছবিগুলি তুলেছেন সুদীপ ভট্টাচার্য, কল্লোল প্রামাণিক ও গৌতম প্রামাণিক।
তাঁরা এলেন। পেট্রোল ভরলেন। এবং পাম্প থেকে চলে গেলেন।
হেলমেট? সে এক ঘোর গল্প।
নদিয়া-মুর্শিদাবাদের দুই জেলা সদর, কৃষ্ণনগর ও বহরমপুরে অন্তত বেশ কয়েকজন বাইক চালককে এ দিন প্রশ্নটা করা হয়েছিল। কেউ কপাল কুঁচকে এক বার তাকিয়ে ধুম সিনেমার কায়দায় ধাঁ। কেউ পাল্টা জিজ্ঞেস করেছেন, ‘‘কীসের হেলমেট?’’ কেউ আবার অত্যন্ত অবজ্ঞার সঙ্গে জানিয়েছেন— ‘‘ফেলছি কড়ি, ভরছি তেল। হেলমেট দিয়ে কী হবে ভাই?’’
নিট ফল— করিমপুর থেকে কল্যাণী, জলঙ্গি থেকে জঙ্গিপুর, হেলমেট ছাড়াই দিব্যি ছুটছে (উড়ছে বললেও বোধহয় ভুল হবে না) মোটরবাইক।
পথ-নিরাপত্তা নিয়ে শুক্রবার কলকাতার নজরুল মঞ্চে পরিবহণ দফতরের কর্তা এবং কলকাতা পুলিশের অফিসারদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্পষ্ট করে দিয়েছেন—রাতের কলকাতায় মোটরবাইক নিয়ে বেলেল্লাপনা নৈব নৈব চ। শহরের ব্যাস্ত উড়ালপুলে রাতের বাইক-শাসনও নয়। হেলমেটহীন বাইক চালকদের নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন তিনি। দিদির দাওয়াই— হেলমেট না থাকলে পাম্পে যেন তেল না দেওয়া হয়।
ওই বৈঠকের পরে শুক্রবার রাতেই কলকাতার পেট্রোল পাম্পগুলির উদ্দেশে একটি নির্দেশিকা জারি করে কলকাতা পুলিশ। সেখানে বলা হয়েছে—‘নো হেলমেট, নো পেট্রোল’। অর্থাৎ হেলমেট না থাকলে বাইক আরোহীকে বাস্তবিকই পেট্রোল-ডিজেল বিক্রি করা যাবে না। নির্দেশ অমান্য করলে পাম্প মালিকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। তারপর থেকে পেট্রল পাম্পগুলি তৎপর হলেও বেশির ভাগ জায়গায় চালকদের দেখা গিয়েছে হেলমেট নিয়ে লুকোচুরি খেলতে। অনেককে হেলমেট ধার করে পেট্রোল ভরতে দেখা গিয়েছে।
খাস কলকাতার যখন এই হাল তখন নদিয়া-মুর্শিদাবাদের ছবিটা কী হতে পারে তা বলাই বাহুল্য। যেখানে পেট্রোল পাম্পগুলিতে এখনও পর্যন্ত কোনও নির্দেশিকাই পৌঁছয়নি। তবে কলকাতার বিষয়টি জানতে পেরে উদ্যোগী হয়ে সোমবার বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ রোডে ভূমি সংস্কার দফতরের গা-লাগোয়া এক পেট্রল পাম্প কর্তৃপক্ষ নোটিস ঝুলিয়ে দিয়েছেন—‘হেলমেট ছাড়া আগামী দিনে পেট্রোল দেওয়া সম্ভব নয়।’ ওই পাম্পের মালিক রামকানাই ধর বলছেন, ‘‘প্রশাসনের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনও নির্দেশ পাইনি। কিন্তু গ্রাহকদের সচেতন করতে আমরা এমনটা করেছি।’’ কিন্তু বিষয়টি অজানা থাকায় সেই নোটিস দেখেও চমকে উঠেছেন অনেক চালক।
এ দিনই বহরমপুরে এসেছিলেন পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী। তিনি বলেন, ‘‘আমরা ‘নো হেলমেট, নো পেট্রোল’ স্লোগানের মধ্যে দিয়ে জনসচেতনা বাড়াতে চইছি। সে ক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসনের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। তারা তা পালন করবে। একই ভাবে জনসচেতনতা বাড়াতে জনপ্রতিনিধিরাও তাঁদের ভূমিকা পালন করবে। সচেতনতা বাড়লেই দেখা যাবে হেলমেট ছাড়া কেউ মোটরবাইক চড়ছেন না।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘প্রয়োজনে আইনেরও প্রয়োগ করা হবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ‘সেভ লাইফ, সেফ ড্রাইভ’ স্লোগানের ডাক দিয়েছেন, আমরা তা সফল করবই।’’
তবে পড়শি জেলা নদিয়াতেও হেলমেট ছাড়া পাম্প থেকে পেট্রোল দেওয়া বন্ধ হতে চলেছে। নদিয়ার জেলাশাসক বিজয় ভারতী বলছেন, ‘‘হেলমেট ছাড়া মোটরবাইক চালানোর ফলে দুর্ঘটনা বাড়ছে। সেই কারণেই জেলার পেট্রোল পাম্পগুলি থেকে হেলমেট ছাড়া কোনও মোটরবাইক চালককে পেট্রোল দেওয়া হবে না। চলতি সপ্তাহে পুলিশের সঙ্গে বৈঠক করে এ বিষয়ে পাম্পগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হবে।” তিনি জানান, হেলমেট ছাড়া মোটরবাইকের রেজিস্ট্রেশনও বন্ধ করা হবে। যাঁর নামে বাইকের রেজিস্ট্রেশন হবে, তাঁরই নামে হেলমেট কেনার রশিদ জমা দিতে হবে। তবেই সেই মালিক পরিবহণ দফতরের রেজিস্ট্রেশন নম্বর পাবেন।
জেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন পেট্রোল পাম্প মালিকেরা। তাঁদের দাবি, এই ব্যবস্থা চালু হলে ব্যবসাতে কোনও প্রভাব পড়বে না। বরং দুর্ঘটনায় অনেক রাশ টান যাবে। নদিয়া জেলা পেট্রোলিয়াম ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ মল্লিক বলেন, “হেলমেট পরার আবেদন জানিয়ে চলতি সপ্তাহে প্রতিটি পেট্রোল পাম্পে ব্যানার লাগাব। প্রশাসনের কাছ থেকে নির্দেশিকা এলেই তা কার্যকর করা হবে।’’
কিন্তু মুর্শিদাবাদ ডিস্ট্রিক্ট পেট্রোলিয়াম ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সেন্টু চৌধুরী বলেন, ‘‘কই না তো, কোনও সরকারি নির্দেশ আসেনি তো। আমাদের ইচ্ছে থাকলেই তো হবে না, হাতে কাগজ না থাকলে নিয়মটা চাপাব কী করে?’’
তত দিন হেলমেটে নেই, পেট্রোলে আছি।
(তথ্য সহায়তা— সামসুদ্দিন বিশ্বাস ও শুভাশিস সৈয়দ)