ভেটের দিন মৃত মানুষও ‘জীবিত’ হয়ে যান।
বুথে গিয়ে ভোট দেন তাঁরা। ভোটার তালিকায় থাকা মৃত মানুষটি যদি মহিলা হন তা হলে সুবিধা আরও বেশি। বোরখা পরে জিন্দা হয়ে দিব্যি ভোট দিয়ে আসতে পারেন তিনি। কোন দল কত মৃতের ভোট দেওয়তে পেরেছে তা নিয়ে চাপা একটা প্রতিযোগিতাও চলত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে।
সে সব এ কালের কথা নয়। তখন বুথ দখল শব্দেরও জন্ম হয়নি। কোনও এক আদ্দ্যিকালের সেই ভোট-কথা। সেটাই ছিল তখন ভোট-রিগিং।
এখন থেকে প্রায় ৫০ বছর আগের কথা। বহরমপুর থানা ভেঙে তখন দৌলতাবাদের জন্ম হয়নি। বহরমপুর-জলঙ্গি সড়কের পাশে কলাডাঙা ঘোষপাড়া বাস স্টপ লাগোয়া এলকায় রয়েছে নওদপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। গোটা গ্রামের জন্য বিদ্যালয়েই রয়েছে ২টি বুথ। বিদ্যালয় থেকে ২০০ গজ দূরে খেজুর পাতার পাটি পেতে তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এক দিনের নির্বাচনী কার্যালয়। ভোটার তালিকায় থাকা মৃতের নাম খুঁজতে ব্যস্ত দলীয় কর্মীরা। সেই মৃত ভোটদের হয়ে ভোট দেওয়ার নাম ছিল ‘প্রক্সি ভোট’।
ষাট ছুঁই ছুঁই তামিজুদ্দিন মণ্ডল বলেন, ‘‘প্রক্সি ভোটার ধরা পড়লে কিছুটা হৈচৈ বাধত। তার পর আপোষে মিটে যেত। ভোটের আদি রিগিং এর শুরু এ ভাবেই।’’
ওই সময় ভোট নিশ্চিত করতে প্রার্থী ও তাঁর দলবল মুসলিম মহল্লায় কোরান সঙ্গে নিয়ে ভোটারদের বাড়ি বেরিয়ে পড়তেন। সেই কোরানে ভোটারের হাত রেখে শপথ করে বলিয়ে নেওয়া হত ভোটটা ওই প্রার্থীকেই তিনি দেবেন। তাতেও অনেক প্রার্থী নিশ্চিত হতে পারতেন না। লালগোলার বাহাদুরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের লোকজনের মুখে মুখে ফেরে সেই কাহিনি। সদ্য প্রয়াত এক হাজি কোরান হাতে শপথ করিয়ে নিয়ে নিশ্চিত হতে না পারায় ভোটের আগের দিনের রাতে বাডির পাশে বিশাল তাঁবু খাটাতেন। সেই তাঁবুতে সমবেত লোকদের জন্য হাজির বাড়ি থেকে গ্যালন গ্যালন দিশি মদ আসত বলেও শোনা যায়।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বহরমপুরের নির্মল সরকার প্রথম বুথ দখল ও ছাপ্পা ভোট দেখেন ১৯৭২ সালে। তিনি বলেন, ‘‘ভোটের দিন মারধর করে বিরোধীদের বের দিয়ে বুথের দখল নিয়েছিল শাসকদল কংগ্রেস।’’ রাজ্য জুড়ে একই ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ তুলে প্রতিবাদ জনাতে ওই বিধানসভাকে আরএসপি বাদে অন্য সব বিরোধীদল ‘বয়কট’ করেছিল।
জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার পর রাজ্যে এল বাম শাসনের আমল। সেই আমলে জলঙ্গি থানার সীমানা লাগোয়া ডোমকল থানার শ্রীরামপুর গ্রামের ভোট রিগিং ছিল অভিনব পন্থায়। বুথ থেকে ২০০ গজ দূরে শাসক দলের নিবার্চনী কার্যালয়ে মাইক বেঁধে ঘোষণা কার হত, ‘‘ওই হিকমতের মা! ওই জাব্বার শেখ! কষ্ট করে আবার আসছো ক্যানে গো। বাড়ি ফিরে যাও। তোমার ভোট দেওয়া হয়ে গ্যালছে!’’ মনে রাখতে হবে, ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে বুথ ধখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠায় কেবল ডোমকলেই খুন হয় ১৮ জন।
ছবিটা প্রায় একইরকম রয়েছে নদিয়া জেলাতেও। সেখানেও পুরনো মানুষজনের ভোট-গল্পে কান পাতলে সে সব গল্প উঠে আসে।