প্রতীকী ছবি।
পূর্ব ভারতে বৃহত্তর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হিসেবে লোকে ফরাক্কাকে চেনে।জানে, বৃহত্তম বাঁধ হিসেবেও। কিন্তু ফরাক্কার অতীতও যথেষ্ট গৌরবময়। ইতিহাসবিদেরা দাবি করেছিলেন দু’হাজার বছর আগেও ফরাক্কায় গড়ে উঠেছিল এক প্রাচীন নগর সভ্যতা।
ষাটের দশকে ফরাক্কায় ফিডার ক্যানেল তৈরির জন্য খোঁড়াখুঁড়ির সময় প্রায় দু’হাজার বছরের পুরোনো এই মনুষ্যবসতির সন্ধান মেলে। কিন্তু তা নিয়ে আর কোনও গবেষণাই হয়নি! ফলে উপেক্ষিত হয়েছে ফরাক্কার ইতিহাস। নতুন প্রজন্ম জানেই না এক সময়ে ফরাক্কায় গড়ে ওঠা সুপ্রাচীন শহরের সে কথা। তাঁরা মাটির পুতুল বানাতেন, মৃত মানুষকে কবর দিতেন।
সময়টা ১৯৬২ সাল। ফরাক্কায় থেকে আহিরণ পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার ফিডার ক্যালেনের জন্য শুরু হয়েছিল মাটি খোঁড়ার কাজ। কলকাতা বন্দরকে বাঁচাতে এই ক্যানাল খোঁড়াখুড়ির কাজ শুরু হলেও এই খনন ফরাক্কার হারিয়ে যাওয়া অতীতের উপর নতুন করে আলো ফেলেছিল। মাটি খুঁড়ে মিলেছিল প্রাচীন সব তৈজসপত্র, যা ফরাক্কার জনবসতির ইতিহাসকে আরও পিছিয়ে দেয়। প্রাপ্ত তৈজসপত্র থেকে ইতিহাসবিদদের অনুমান, মৌর্য-শুঙ্গ যুগেও ফরাক্কায় মনুষ্যবসতি ছিল।
সেই ১৯৭৫ সালে রাজ্যের তৎকালীন রাজ্য প্রত্ন দফতরের কর্তা পরেশচন্দ্র হালদার ফরাক্কার প্রাচীন জনবসতিকে প্রাক মৌর্যযুগের বলে জানিয়েছিলেন। তিনি আরও জানান, ফরাক্কা থেকে অজয় নদের অববাহিকা পর্যন্ত রাঢ় অঞ্চলে প্রাক আর্য দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর বাস ছিল যাঁরা উন্নত সভ্যতার অধিকারী ছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গ পুরাতত্ত্ব দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, খননের সময় অসংখ্য পোড়ামাটির মাতৃকা মূর্তি মেলে। খননের যত গভীরে যাওয়া গিয়েছে মূর্তির সংখ্যা তত বেড়েছে। অবশেষে গঙ্গা ও গুমানি নদীর সংযোগস্থলের নৌবাহী খাল কাটার সময় এক প্রাচীন নগরের হদিস পাওয়া যায় বলে ইতিহাসবিদেরা দাবি করেছিলেন। সেখান থেকে বিভিন্ন সময়ের ব্যবহৃত নানা ধরনের মাটির পাত্র, পোড়া মাটির মূর্তি, অঙ্ক চিহ্নিত রুপোর মুদ্রা, নৌকো, তালের ডোঙা, মেখলা পরিহিত অপ্সরা ও দেবী মূর্তি, মৌর্য-শুঙ্গ যুগের স্বর্ণমুদ্রা, গুপ্ত যুগের উন্নত মানের মাটির পাত্র, সমাধিস্থান ও নরকঙ্কাল মেলে।
এই সব নিদর্শনের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে অজয় নদের তীরে পান্ডু রাজার ঢিবিতে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলির।
ফরাক্কায় প্রাপ্ত মৃৎপাত্র বা স্বর্ণমুদ্রা রাজ্যের প্রত্ন বিভাগের সংগ্রহশালায় রাখা হয়েছে। সেগুলিতে কোনওটিতে সূর্য, কোনওটিতে জলাশয়, কোনওটিতে ঘোড়ার ছবি আঁকা। একে মৌর্য থেকে খ্রিস্টীয় শতকের মনুষ্যবসতির নিদর্শন বলেই মনে করেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা।
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালের এই সব নিদর্শনগুলি বলে মনে করা হয়। ফরাক্কার এইসব নিদর্শনের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে বর্ধমানের পান্ডু রাজার ঢিবি, মঙ্গলকোট, মেদিনীপুরের তাম্রলিপ্ত ও ২৪ পরগনার চন্দ্রকেতু গড়ে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলির।
পশ্চিমবঙ্গ পুরাতত্ত্ব অধিকারের মতে, ফরাক্কায় ৪টি স্তরে বসতির নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। সর্বনিম্ন স্তরে মাটির বলয় সমন্বিত কূপ ও আদিম যুগের পোড়ামাটির নারীমূর্তি মেলে। দ্বিতীয় স্তরে বাদামি রঙের মৃৎপাত্র। এগুলির সঙ্গে পান্ডুরাজার ঢিবিতে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলির মিল রয়েছে। তৃতীয় স্তরে পাওয়া যায় মৌর্য-শুঙ্গ যুগের ১৬টি স্বর্ণমুদ্রা ও উত্তর ভারতের কৃষ্ণবর্ণের মসৃণ পাত্র। চতুর্থ বা সর্বোচ্চ স্তরে মেলে কুষাণ ও আদি গুপ্ত যুগের নিদর্শন। পোড়ামাটির পাত্রগুলি নলযুক্ত রোমক মৃৎপাত্রের মতো।