প্রতীকী ছবি
সোমবার খুশির ইদ, কিন্তু মন ভাল নেই ওঁদের কারও। এবারের ইদে যে সামান্য আনন্দও নেই ওঁদের মনে। একে করোনার সংক্রমণ, তার জেরে চলা দীর্ঘ লকডাউন, কাজহারানো মানুষের ভিড়, পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফিরতে না পারার মতো একাধিক সঙ্কটের উপরে আবার যোগ হয়েছে সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় আমপানের ক্ষয়ক্ষতি। চারদিক দিয়ে খারাপ সময় জাপটে ধরেছে ওঁদের। তাই খুশির ইদ এলেও খুশি হলে পারছেন না কেউ।
অন্য বছর ইদের রমজান মাসের শুরু থেকেই সকলে মেতে ওঠেন আনন্দে। এ বছর সেই আনন্দ নেই তাঁদের কারও মনে। বুধবার গভীর রাতে জেলায় আমপান ঝড় এসে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে চলে গিয়েছে। কারও ঘর ভেঙেছে, কারও মাথার চাল উড়ে গিয়েছে, কারও আবার শস্য ডুবে গিয়েছে জলে। কারও রোজগারের একমাত্র সম্বল ঠেলাগাড়িটাই ঝড়ে গিয়েছে গুঁড়িয়ে।
শনিবার সকালে ভেঙে পড়া বাড়ি ঠিক করতে করতে এক ব্যক্তি বলেন— ‘‘ঝড়ে ঘরের চাল উড়েছে, সেটা সবাই জানে। আর আমার স্বপ্নটা? সেটাও তো দুমড়ে গেল।’’
দীর্ঘ প্রায় দু’মাস ধরে লকডাউন চলছে। যার জেরে নিম্ন-মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের রোজগার বন্ধ। হাতে টাকা নেই, তাই এ বছরের ইদে কেনাকাটার কথা ভাবেননি ওঁরা। অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে ইদের আনন্দ ফিকে হলেও নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করেছিলেন ওঁরা। সবে সবে দোকানপাট খুলতে শুরু করেছিল। চতুর্থ দফার লকডাউনে এসে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছিল সবকিছু। তার মধ্যেই হঠাৎ করে আছড়ে পড়ল ঘূর্ণিঝড়। যে কারণে কেউ বাড়ি হারিয়েছেন, কারও আবার বিঘের পর বিঘে জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। মাথায় হাত পড়েছে কৃষক, ব্যবসায়ী, শ্রমিক থেকে রিকশা বা ভ্যানচালকের মতো সবার। রোজগার খাবার জোগাড়ের চিন্তার সঙ্গে উপরি যোগ হয়েছে মাথাগোঁজার বাসস্থান মেরামতের চিন্তা, ফসলের উপরে লগ্নি করা অর্থরাশির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা। ঠিক সেই কারণেই ইদের দুই দিন আগেও কোনও আনন্দ বা প্রস্তুতি নেই গ্রামের মানুষের ঘরে।
শনিবার বড়চাঁদঘর এলাকার উত্তর পাড়ায় গিয়ে দেখা গেল, খিলাফত শেখ নামে এক ব্যক্তির মাটির বাড়ির একটা দেওয়াল ঝড়ে পুরোপুরি ভেঙে গিয়েছে। পাশের অন্য আর একটি দেওয়াল কিছুটা বসে গিয়েছে। তিনি নিজেই তা সারানোর ব্যবস্থা করে চলেছেন। মাটি তুলে তুলে জড়ো করছেন এক জায়গায়।
এ দিন ইদের প্রসঙ্গ তুলতেই হতাশ খিলাফত শেখের জবাব, ‘‘আর ইদ! এ বছর সবকিছু শেষ হয়ে গেল।’’
তিনি জানান, পরের কিছু জমি নিয়ে ভাগচাষ করেন। এবার জমিতে ভুট্টা ও তিল বুনেছিলেন। কিন্তু ঝড়ে সব গাছ শুয়ে গিয়েছে। কিছুই টাকা পাবেন না। খিলাফতের আর্তি, ‘‘কী ভাবে দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকব, সেটাই বুঝতে পারছি না।’’
ওই গ্রামেরই আর এক ব্যক্তি হাফিজুদ্দিন মিরের চালার ঘর ভেঙেছে ঝড়ে। তিনিও সেই ঘর ঠিক করতেই বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতির মধ্যে আর আনন্দ করব কী করে? ঘরে বাচ্চারা আছে। সমাজ থেকে যে সাহায্য পাব ওই দিয়ে বাচ্চাদের মুখে কিছু তুলে দেব।’’
ওই গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা মুজাফফর শেখ বলেন, ‘‘অন্যান্য বছর কয়েক দিন আগে থেকে বাচ্চারা এই সময়ে মসজিদ, বাড়িঘর সাজানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। এ বছর তার কিছুই নেই।’’
কিছুই যে নেই, তার প্রমাণ গ্রামের ভাঙা বাড়িগুলোর পাশে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা লোকগুলো। যাঁরা এখনও বুঝেই উঠতে পারছেন না, লড়াইটা কোথা থেকে শুরু করবেন!
ইদের আনন্দ তো দূর অস্ত্।