অমরের কান্না সত্ত্বেও দল অনড়

ক্ষমতায় ফিরেই দলীয় কর্মীদের বার্তা দিয়েছিলেন— এমন কিছু করা চলবে না, যাতে দলের গায়ে কালি লাগে।

Advertisement

সুপ্রকাশ মণ্ডল ও সৌমিত্র সিকদার

কল্যাণী শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৬ ০১:৫১
Share:

কল্যাণীর জেএনএম হাসপাতালে খাদ্যমন্ত্রী। — নিজস্ব চিত্র

ক্ষমতায় ফিরেই দলীয় কর্মীদের বার্তা দিয়েছিলেন— এমন কিছু করা চলবে না, যাতে দলের গায়ে কালি লাগে।

Advertisement

শিক্ষাঙ্গনে দাপাদাপি থেকে সিন্ডিকেটে ‘না’। মুখ্যমন্ত্রী সেই নির্দেশ অবশ্য সর্বত্র যে মাথা পেতে মান্য করা হচ্ছে, সরকার গঠনের দেড় মাস পরেও তা বলা যাচ্ছে না। তাই কখনও তিন বিধায়ককে তলব করে সিন্ডিকেট নিয়ে সতর্ক করা হচ্ছে। কখনও বা সল্টলেকের এক কাউন্সিলরকে একেবারে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছেন তিনি।

কল্যাণীর দাপুটে কাউন্সিলর অমর রায়ের ডানা ছাঁটতেও এ বার সে পথেই হাঁটার কতা ভাবছে দল, শুক্রবার তেমনই বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে তাঁকে।

Advertisement

কল্যাণীর জেএনএম হাসপাতালে আয়া নিয়ন্ত্রণ থেকে অ্যাম্বুল্যান্স— সব ক্ষেত্রেই ওই কাউন্সিলরের দাপট খর্ব করা হয়েছে। এ দিন ওই হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক স্পষ্টই তাঁকে দিদির নির্দেশ আরও এক বার স্মরণ করিয়ে সতর্কও করে এসেছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে।

সোমবার কল্যাণী জেএনএম মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র ডাক্তারদের মারধরের ঘটনায় নাম জড়িয়েছিল স্থানীয় ওই কাউন্সিলর অমর রায়ের ছেলে গৌতমের। পুলিশ তাকে গ্রেফতারও করেছিল। অভিযোগ, সে ওষুধ চক্রের পাণ্ডা।

শুক্রবার জরুরী বৈঠক ডেকে সেই অমর রায়কে সরাসরি দল থেকে বের করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয়। একই হুঁশিয়ারি দিলেন জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তও। বৈঠকে ঘোষণা করা হল, রাশ টানা হবে আয়াদের দাপাদাপিতে।

বৈঠকে উপস্থিত অনেকেই জানিয়েছেন, ধারাবাহিক হুঁশিয়ারিতে কার্যত ভেঙে পড়ে এক প্রস্থ নাটকও করেন অমরবাবু। সরাসরি হুমড়ি খেয়ে জ্যোতিপ্রিয়র কোলে মাথা রেখে অঝোরে কেঁদে কেটে বাসান তিনি। আর্জি জানান, ছেলের দোষে তাঁকে যেন কঠোর শাস্তি না দেওয়া হয়। যদিও সেই নিশ্চয়তা তাঁকে দেওয়া যায়নি। তাঁর এই আচরণকে কুমিরের কান্নাই বলছেন তৃণমূলেরই একাংশ।

অভিযো‌গ, গত সোমবার গৌতমের নেতৃত্বে এক দল যুবক হাসপাতালের সামনে কয়েকজন জুনিয়র ডাক্তারকে মারধর করে। আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হুমকি দেওয়া হয় এক চিকিৎসককে। তার পরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এত দিন অমরের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে না পারা অনেকেই প্রশাসনের উপরের তলায় পুরো ঘটনাটি জানান। তার জেরেই এ দিনের জরুরী বৈঠক। বৈঠকে ছিলেন নদিয়া জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত, কল্যাণী শহর তৃণমূলের সভাপতি অরূপ মুখোপাধ্যায়ও।

সভার শুরুতেই প্রশাসনের কর্তারা পরিষ্কার করে দেন, কিছু দালাল এবং সিন্ডিকেটের জন্য এই হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে আসা সাধারণ মানুষের গাঁট কাটা যাচ্ছে। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে চলছে আয়াদের খবরদারি। তাদের দাবি মতো টাকা না দিলে হেনস্তা করা হচ্ছে রোগীর বাড়ির লোকজনকে। তাদের দৌরাত্ম্যে রোগীদেরও প্রাণান্তকর অবস্থা।

তাদের ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতে হয় চিকিৎসক-নার্সদের। এর পরে যদি চিকিৎসকদের বন্দুকের নলের সামনে পড়তে হয়, তা হলে সমাজের সব স্তরেই খারাপ বার্তা যাবে।

এই ঘটনা শোনার পরেই জ্যোতিপ্রিয়বাবু বলেন, ‘‘এই ঘটনা মানা যাবে না। তাতে যদি আমাদের দলের কেউ জড়িত থাকে, তাকে বের করে দেওয়া হবে।’’ তিনি জানান, মুখ্যমন্ত্রীর কড়া নির্দেশ রয়েছে, এই ধরণের কাজে যেই যদি জড়িত থাকুন না কেন, কড়া শাস্তি হবে তাঁর। গৌরীশঙ্করও বলেন, ‘‘আমি পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছি, যাঁরা দলের নাম ভাঙিয়ে এই কাজ করছেন, বন্ধ করুন। তা না হলে তাঁকে দল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে।’’

জ্যোতিপ্রিয়বাবু নির্দেশ দেন, জুনিয়র জাক্তারদের মারধর বা ওষুধ চক্র নিয়ে কী ঘটছে তার বিস্তারিত তদন্ত করবেন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ এবং মেডিক্যাল সুপার। তাঁরা রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে রিপোর্ট দেবেন। সেই রিপোর্ট জ্যোতিপ্রিয়র হাতে পৌঁছলে, তিনি প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেবেন। তবে এই ঘটনায় যাঁরা জড়িত, তাদের গ্রেফতার করতে হবে।

বৈঠকে হাসপাতালের পরিষেবা সংক্রান্ত বিষয়ে ধারাবাহিক নজরদারির জন্য একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছে। তার মাথায় রয়েছেন মহকুমা শাসক স্বপন কুণ্ডু। অধ্যক্ষ, মেডিক্যাল সুপার ছাড়াও কমিটিতে রয়েছেনস এসডিপিও এবং চার সহকারী মেডিক্যাল সুপার। রোগী কল্যাণ সমিতির সদস্য হওয়া সত্ত্বেও অমরের ঠাঁই হয়নি কমিটিতে।

বৈঠকে ঠিক হয়, প্রতি ১৫ দিন অন্তর রোগী কল্যাণ সমিতি বৈঠকে বসবে। হাসপাতালের সব বিভাগে নজরদারি করবেন সহকারী সুপাররা। হাসপাতালের বিভিন্ন জায়গায় বোর্ডে বড় বড় করে লিখে রাখতে হবে, কোনও পরিষেবার জন্য রোগীদের কোনও টাকা দিতে হবে না। কেউ টাকা চাইলে কার কাছে অভিযোগ করবেন, সেই ফেন নম্বরও লেখা থাকবে। কলেজের পড়ুয়াদের বলা হয়েছে রাত পর্যন্ত বাইরে না থেকে তাড়াতাড়ি হস্টেলে ফিরতে হবে।

পরে জ্যোতিপ্রিয় বলেন, ‘‘আয়াদের চক্র ভেঙে ফেলা হবে। রোগীদের দেখভাল করার জন্য নতুন ১৫০ জনকে নিয়োগ করা হবে। তাঁদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে। এর জন্য রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় একটি পাঠ্যক্রম তৈরি করবে।’’

তৃণমূল ছাত্র পরিষদের মেডিকেল কলেজ শাখার সভাপতি সৌম্যব্রত মিত্র জানিয়েছেন, চিকিৎসকদের মারধরের ঘয়নার প্রতিবাদে শুক্রবার বিকালে ধিক্কার মিছিল করা হবে। তিনি বলেন, “আমরা চাই সরকারী নিয়ম মেনে কাজ করতে। সেটা করতে গিয়েই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। সেটা যাতে না হয়, সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছি।”

শেষে তা হলে কাঁদতে হল?

এ প্রশ্নের উত্তরে অমরবাবু বলেন, ‘‘হতেও পারে। তবে এ ব্যাপারে যা বলার খাদ্যমন্ত্রীই বলবেন।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement