প্রতীকী চিত্র।
প্রথমে তিনি বলেছিলেন, ‘অন্য দেশের’ লোকজনের ছবি নিয়ে কলেজে মিছিল করা চলবে না। করলে মার খেতে হবে। চব্বিশ ঘণ্টা কাটতে না-কাটতেই ঢোঁক গিলে এবিভিপি নেতা জানালেন — নিউটন, আইনস্টাইন, ডারউইন, শেক্সপিয়রের মতো বিদেশিদের ক্ষেত্রে তাদের কোনও আপত্তি নেই। আপত্তি শুধু অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্কস বা তাঁর তত্ত্বের অনুগামী মনীষীদের নিয়ে। সেই কারণেই তারা বুধবার মাজদিয়া সুধীরঞ্জন লাহিড়ী মহাবিদ্যালয় চত্বরে মার্কস-লেনিনের ছবি নিয়ে মিছিল করা এসএফআই সমর্থকদের উপরে হামলা চালিয়েছিল। এবং সুযোগ পেলে তাঁরা পাঠ্যসূচি থেকে মার্কসবাদ বাদ দিতে চান।
বুধবার ওই গোলমালের পরেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ওই ছাত্র সংগঠনের নদিয়া জেলা প্রমূখ আশিস বিশ্বাস হুমকি দিয়েছিলেন, অন্য দেশের কারও ছবি নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে মিছিল করতে দেবেন না। করলে ফের হামলা করা হবে। তাঁর বক্তব্য সামনে আসার পর জেলা জুড়ে বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। ‘বিদেশি’ বলতে এবিভিপি কাদের নিশানা করছে, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। এ বার পদার্থবিদ্যার পাঠ্যবই থেকে নিউটন-আইনস্টাইন, জীববিদ্যা থেকে ডারউইন, এমনকি ইংরেজি সাহিত্য থেকে শেক্সপিয়রকে ছেঁটে ফেলার দাবিও উঠবে কি না, সেই প্রশ্ন তুলে এবিভিপি-র মতিগতি নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করেন অনেকে। বিশেষত যে ভাবে কিছু হিন্দুত্ববাদী নেতা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব বিষয় প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে খুঁজে পাচ্ছেন এবং গোমূত্র দিয়ে যে কোনও রোগ সারানোর দাওয়াই বাতলাচ্ছেন, তাতে এই সন্দেহ উড়িয়ে দিতে পারেননি অনেকেই।
বেগতিক বুঝে বৃহস্পতিবার আগের অবস্থান থেকে সরে এবিভিপি জেলা প্রমুখ ব্যাখ্যা করেন, “আমরা আসলে বিদেশি বলে মার্কস লেনিনের বিরোধীতা করছি না। বিরোধিতা করছি সেই মতাদর্শের যা সারা বিশ্বে আজ ব্রাত্য হয়ে গিয়েছে। মার্কসবাদ যে মানুষকে কোনও লক্ষ্য বা পথ দেখাতে পারে না তা আজ দেশে দেশে পরীক্ষিত সত্য। সেই কারণেই এই ভুল বস্তাপচা মতাদর্শকে আমরা কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেব না।”
এবিভিপি কি সুযোগ পেলে মার্কসবাদ পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেবে? আশিস বলেন, “বিজেপি এই রাজ্যে ক্ষমতায় এলে আমরা পাঠ্যসূচি থেকে মার্কসবাদকে বাদ দেব। কোনও ভ্রান্ত বাতিল মতবাদের শিক্ষা পড়ুয়াদের দিতে দেব না।”
কিন্তু মার্কসবাদ বাদ দিয়ে কি আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির পাঠ দেওয়া সম্ভব?
কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজের অর্থনীতির শিক্ষিকা মহুয়া চক্রবর্তীর মতে, “অর্থনীতি যে কটা চিন্তাধারার উপরে দাঁড়িয়ে আছে, অর্থনীতি বুঝতে গেলে তার একটাকেও বাদ দেওয়া যাবে না। সেই কারণে মার্কসবাদও বাদ দেওয়া চলবে না। কখন, কোন পরিস্থিতিতে কোন তত্ত্ব প্রয়োগ সম্ভব, সেটা আলাদা বিষয়। কিন্তু মার্কসবাদ বাদ দিয়ে অর্থনীতি বোঝা সম্ভব নয়।” এই কলেজেরই অর্থনীতির ছাত্র সাগর হালদার বলেন, “মার্কসবাদ বাদ দিয়ে সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতি বোঝা সম্ভব না। যাঁরা এ সব বলছেন, তাঁদের শিক্ষা নিয়েই প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হয়।”
দ্বিজেন্দ্রলাল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান শিক্ষক পরীক্ষিত ঠাকুর আবার বলেন, ‘‘এখন যদি কোনও সর্বগ্রাসী আগ্রাসন থাকে, সেটা পুঁজির। রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে সার্বিক ভাবে বুঝতে গেলে মার্কসবাদ তার অতি প্রাসঙ্গিক অঙ্গ। এই তত্ত্ব বাদ দিলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অসম্পূর্ণ। যাঁরা এ সব বলছেন, তাঁদের বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান নেই।’’ রানাঘাট কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রী রিয়া বালার মতে, ‘‘সভ্যতায় পিছিয়ে পড়া মানুষকে বুঝতে গেলে মার্কসবাদ বুঝতেই হবে। তা পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেওয়ার কথা ভাবাই যায় না।’’
প্রত্যাশিত ভাবেই, তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে ছাত্র সংগঠনগুলিরও।
এসএফআইয়ের জেলা সম্পাদক মৌপ্রিয়া রাহা বলেন, “ওরা তো গাঁধীঘাতী গডসে আর ব্রিটিশের কাছে মুচলেকা দেওয়া সাভারকরের উত্তরসূরি। আর আমরা শুধু মার্কস-লেনিন নয়, সেই সঙ্গেই ভগৎ সিংহ, ক্ষুদিরামদের মতাদর্শেও বিশ্বাসী।” তাঁর চ্যালেঞ্জ, ‘‘আমরা আবার মার্কস-লেনিনের ছবি নিয়ে মিছিল করব। এবিভিপি জানে না যে বন্দুক দেখিয়ে মতাদর্শকে খুন করা যায় না। যেখানেই মতাদর্শের লড়াই হয়েছে সেখানেই আমাদের জয় হয়েছে। জেএনইউ থেকে যাদবপুর— আমরা জিতছি এবং জিতব।”
টিএমসিপি-র জেলা সভাপতি সৌরিক মুখোপাধ্যায়ও বলেন, “যারা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা ধ্বংস করতে চাইছে, মিশ্র অর্থনীতির ধারণা ধ্বংস করে ধান্দাবাজের ধনতন্ত্র কায়েম করতে চাইছে, তারা সমাজতন্ত্রের কথা পাঠ্যসূচি থেকে উড়িয়ে দেওয়ার কথা বলবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।” তবে সেই সঙ্গেই তাঁর দাবি, “এই রাজ্যের বামপন্থীরা অনেক আগেই মার্কসবাদ ভুলে গিয়েছে। এরা শুধু ভণ্ডামিতে বিশ্বাস করে।”