বর্ষায় ধান। আর শীতে ধনে। নদিয়াতে এমন ভাবেই বদলে যাচ্ছে চাষের নকশা। জেলা উদ্যান পালন দফতর জানাচ্ছে, জেলার কৃষ্ণনগর ও তেহট্ট মহকুমার চাষিদের একটা বড় অংশ শীতকালে ধনে চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। গত বছর জেলায় প্রায় তিন হাজার হেক্টর জমিতে ধনে চাষ হয়েছে। দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘পাট, আখের বাজারে মন্দা দেখা দেওয়ার অর্থকরী ফসল হিসেবে ধনে চাষের পরিমাণ বাড়ছে।’’
বর্ষাকালে ধান চাষের পাশাপাশি অনেকে ধনে চাষও করেন, তবে তা প্রধানত ধনে পাতার জন্য। মশলা হিসেবে ধনে যেখানে ভিন রাজ্যে যায়, সেখানে ধনেপাতার চাহিদা জেলার বাজারে চড়া। নদিয়ার আটটি ব্লকে প্রায় সব চাষিই ধনেপাতা চাষ করছেন কমবেশি। ধুবুলিয়ার চাষি শঙ্কর মণ্ডল বলেন, ‘‘শীতকাল ছাড়াও প্রায় সারা বছরই পাতার জন্য অল্প জমিতে ধনের চাষ করি। ধনে পাতার বাজারে ভাল চাহিদা রয়েছে। এক কিলোগ্রাম ধনে পাতা বেচে অন্তত পাঁচশো টাকা মেলে।’’ জেলা উদ্যান পালন দফতরের কর্তারাও জানাচ্ছেন, জেলার সব জায়গায় ধনে পাতার সারা বছরই চাহিদা থাকে। ফলে চাষিরা কেবলমাত্র পাতার জন্য ধনে চাষে দিন দিন আগ্রহী হচ্ছেন।
নদিয়া জেলার বেশির ভাগ এলাকার জমিই উর্বর এবং বহুফসলি। চাষিরা এক সময় সারা বছরই ধান চাষ করতেন। কিছু জমিতে হত পাট ও আখ। তাঁরা এখন ঝুঁকছেন ধনের দিকে। বেথুয়াডহরি, চ্যাঙা, নাজিরপুর, বেতাই, হরিপুর, দেবনাথপুর প্রভৃতি জায়গায় রয়েছে ধনের বাজার। সেখান থেকে গাড়ি ভর্তি ধনে যায় রাজ্যের বাইরে। বিহারের সমস্তিপুর ও উত্তর প্রদেশের গোরক্ষপুরে। ধনে কারবারি বিপ্লব বারুই বলেন, ‘‘আগে ধনের বাজার কেবল নাজিরপুরে ছিল। এখন তা আশপাশের বেশ কিছু এলাকায় ছড়িয়ে গিয়েছে।’’ ছোট হলেও ধনের বাজার রয়েছে কল্যাণী মহকুমার চাকদহ এলাকাতেও।
ধনে চাষ ধানের থেকে লাভজনক। নদিয়া জেলার উদ্যান পালন আধিকারিক কৃষ্ণেন্দু ঘোড়াই বলেন, ‘‘এক বিঘে জমিতে ধান চাষ করতে যা খরচ হয়, তার ৪০ শতাংশ ব্যয় হয় ধনে চাষ করতে।’’ অন্য দিকে, এক বিঘের ধান বিক্রি করে যা দাম মেলে, এক বিঘে জমিতে উৎপন্ন ধনে বিক্রি করে মেলে তার দ্বিগুণ।
মূলত কার্তিক মাসে বোনা হয় ধনে। আর ফসল ওঠে ফাল্গুনের শেষের দিকে বা চৈত্রের শুরুতে। চাষিরা জানাচ্ছেন, ধনে চাষির ক্ষেত্রে এই চার মাসে সেচ দিতে হয় মাত্র এক বার। রাসায়নিক সার দিতে হয় বার দু’য়েক। সব মিলিয়ে এক বিঘে জমির ধনে ঘরে তুলতে খরচ হয় দু’হাজার টাকা। বিভিন্ন এলাকার চাষিরা জানাচ্ছেন, ধনের বর্তমান বাজার দর প্রতি কুইন্ট্যাল আট হাজার টাকা। এক বিঘে জমির ধনে বিক্রি করে চাষি পান প্রায় ২৪ হাজার টাকা।
অন্য দিকে, শীতে ধান চাষের অনেক হ্যাপা। নদিয়ার দেবগ্রাম এলাকার চাষি জাকির শেখ জানান, ধান চাষ করতে ১০-১২ বার সেচ দিতে হয়। ধানে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ বেশি বলে ঘন ঘন কীটনাশক স্প্রে করতে হয়। চাষের খরচ অনেকটাই বেড়ে যায়। এক বিঘে জমিতে ধান চাষ করতে খরচ হয় কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা। আর ফলন ভাল হলে বিঘেতে যা ধান হয়, তা বিক্রি করে দাম মেলে প্রায় ১২ হাজার টাকা।
তাছাড়া ধান ওঠার সময়ে তা বিক্রি করার বিস্তর ঝক্কি। সরকারি সমবায়ে ধান বিক্রি নিয়ে ফি বছর নানা সমস্যা হয়। কিন্তু ধনের ক্ষেত্রে বাজারের সে সমস্যা নেই।
বেথুয়াডহরি এলাকার ধনের কারবারিরা জানাচ্ছেন, উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় থাকে ধনে। বিশেষত বিহার-উত্তর প্রদেশে ধনের প্রচুর চাহিদা। তাকে কাজে লাগান পশ্চিমবঙ্গ ও রাজস্থানের ধনের কারবারিরা। খেত থেকে ধনে উঠতে না-উঠতেই চাষিদের বাড়িতে হাজির হয়ে যান ব্যবসায়ীরা।
বেথুয়াডহরির বাসিন্দা কালু বৈদ্য বলেন, ‘‘আমার দু’টো ১০-চাকার গাড়ি রয়েছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ভিন রাজ্যের ব্যবসায়ীরা এসে গাড়ি ভর্তি করে ধনে নিয়ে ফিরে যান।’’ ধনের এই চাহিদার কথা মাথায় রেখে কালীগঞ্জের এক জন সম্পন্ন চাষি আবুবক্কর শেখ বলেন, ‘‘গত বছর ১৫ বিঘে জমিতে ধনে চাষ করে বেশ ভাল লাভই করেছি। এ বার ভাবছি শীতে ধান চাষ আরও খানিকটা কমিয়ে দিয়ে ধনের চাষের পরিমাণ বাড়াব।’’