ফাইল চিত্র।
বোঝার উপরে শাকের আঁটি নয়, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের বিপুল বোঝার উপরে জিএসটি-র বিপুলতর বোঝা রাজ্য সরকারের ভাঁড়ারের দুরবস্থাকে চোখ রাঙাচ্ছে। স্বাস্থ্যসাথীর সুবিধা যখন রাজ্যের সব নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, সেই সময় স্বাস্থ্য পরিষেবায় জিএসটি-র ভ্রুকুটি ছিল না। কিন্তু এখন সেই বাড়তি খরচ ব্যথা বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও। প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, স্বাস্থ্যে জিএসটি-র বোঝা স্বাস্থ্যসাথীর উপরেও পরোক্ষ প্রভাব ফেলবে। তাতে খরচ বেড়ে যেতে পারে কয়েকশো কোটি টাকা। রাজ্যের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিতে তার কতটা সামাল দেওয়া যাবে, সেই চিন্তা এখন রীতিমতো আশঙ্কার রূপ নিয়েছে রাজ্য প্রশাসনের অন্দরে।
সূচনা পর্বে স্বাস্থ্যসাথীর সুবিধা নির্দিষ্ট ছিল সমাজের কিছু অংশের মানুষের জন্য। তখন এই প্রকল্পের খরচ সরকারের নাগালেই ছিল। পরে উপভোক্তা-পরিধি বাড়তে বাড়তে এখন যে-কোনও নাগরিক চাইলেই স্বাস্থ্যসাথীর সুবিধা পেতে পারেন। সরকারি সূত্রের খবর, এখন রাজ্যে স্বাস্থ্যসাথী উপভোক্তা পরিবারের সংখ্যা প্রায় দু’কোটি বত্রিশ লক্ষ। এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে আয়ের কোনও ঊর্ধ্বসীমা রাখেনি রাজ্য। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানাচ্ছে, স্বাস্থ্যসাথীতে এ বছর (২০২২-২৩) কমবেশি ২৫০০ কোটি টাকা খরচ ধরে রেখেছে সরকার। জিএসটি কাউন্সিলের গত বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আইসিইউ ছাড়া পাঁচ হাজার টাকার বেশি কেবিন ভাড়ার উপরে ৫% এবং মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ১২% জিএসটি বসানো হবে। অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে বিমার প্রিমিয়ামের উপরে জিএসটি-র ১৮% হারও। অনেক প্রশাসনিক ও আর্থিক পর্যবেক্ষকের বক্তব্য, ন্যূনতম ৫% জিএসটি-র জেরে পরোক্ষ প্রভাবে স্বাস্থ্যসাথীর খরচ বাড়তে পারে আরও ১২০-১২৫ কোটি টাকা। এবং এই অতিরিক্ত অর্থের সংস্থান করতে মাথা ঘামাতে হবে অর্থকর্তাদের।
সংশ্লিষ্ট মহলের যুক্তি, শয্যা-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে খরচ বাড়লে তার প্রভাব চিকিৎসা বিলের উপরে পড়তে পারে। বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসার খরচের ‘প্যাকেজ’-এর মধ্যেই হাসপাতালের ঘর ভাড়া ধরা থাকে। তার উপরে কাঁচামালে মেটানো জিএসটি-তে ছাড় বা ‘ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট’ মিলবে না। ফলে চিকিৎসার খরচে করের এই বোঝা মেটাতে হবে সাধারণ মানুষকেই। সে-ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসাথীর আওতায় এখন যে-সরকারি প্যাকেজ মানতে হচ্ছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের কাছে তা পরিমার্জনের দাবি তুলতে পারে হাসপাতাল-নার্সিংহোম। সে-ক্ষেত্রে সরকারের উপরে বাড়তি আর্থিক বোঝা চাপার আশঙ্কা থেকে যাবে। এ ভাবে জিএসটি বসানোর ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিল রাজ্য সরকার। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যে-ভাবে বাড়ছে, তাতে নতুন করের বোঝা চাপানোয় সংশ্লিষ্ট বৈঠকেই বিরোধিতা করেছিল রাজ্য।
প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “স্বাস্থ্যসাথীর আওতায় চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য। কোনও বেসরকারি হাসপাতাল-নার্সিংহোম তা না-মানলে পুলিশের কাছে উপভোক্তাকে অভিযোগ জানাতে বলা হচ্ছে। সেই সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপও করতে পারে সরকার। এ ক্ষেত্রে সরকারের প্যাকেজ নির্দিষ্ট। তবে তাতে খরচ বাড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।” অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া, “এ-সবের ফলে মানুষের উপরে বোঝা চাপবে, সন্দেহ নেই। আমরা তাই প্রথম থেকেই বরাবর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই ধরনের পদক্ষেপের বিরোধিতা করে এসেছি।”
অনেক প্রশাসনিক কর্তা জানান, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের তিন ভাগের এক ভাগ রয়েছে বিমা-পদ্ধতিতে। বাকি তিন ভাগের দু’ভাগ রয়েছে নিশ্চয়তা বা ‘অ্যাসিয়োরেন্স’ ভিত্তিতে। এতে সরকার চিকিৎসার খরচ সরাসরি মিটিয়ে দেয়। জিএসটি-র কারণে দু’টি পদ্ধতির উপরেই চাপ আসতে পারে। তবে কর্তাদের অনেকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, শুধু রাজ্যের স্বাস্থ্যসাথী নয়, সে-ক্ষেত্রে চাপ পড়বে কেন্দ্রের আয়ুষ্মান প্রকল্পের উপরেও। তবে জিএসটি চাপলেও সেই করের অর্ধেক যে রাজ্যের ভাঁড়ারে ঢুকবে, তা মনে করাতে ভুলছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ইতিমধ্যেই অবশ্য স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের কিছু সুবিধায় কার্যত রাশ টানতে শুরু করেছে রাজ্য সরকার। গত মাসেই তারা এক নির্দেশিকায় জানিয়েছে, একমাত্র গুরুতর পরিস্থিতিতে যে-চিকিৎসা বাংলায় হয় না, তখনই স্বাস্থ্যসাথীর আওতায় ভেলোরে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ছাড়পত্র দেওয়া হবে। চিকিৎসক এবং রাজ্যের নোডাল সংস্থা কোনও চিকিৎসার ক্ষেত্রে ছাড়পত্র না-দিলে ভেলোরের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড ব্যবহারের কোনও অনুমতি মিলবে না।
চলতি আর্থিক বছরে কল্যাণ প্রকল্পগুলিতে মোট প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে রাজ্য। সরকারি সূত্র জানাচ্ছে, এর মধ্যে শুধু লক্ষ্মীর ভান্ডারের কমবেশি ১.৭৫ কোটি উপভোক্তাকে প্রতি মাসে আর্থিক সহায়তা দিতেই বছরে খরচ হচ্ছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি (উপভোক্তার সংখ্যা বাড়লে তা আরও বাড়বে) টাকা। সরকারি কর্মী, স্কুল-কলেজের শিক্ষক প্রমুখের বেতন-পেনশন, সরকার চালানোর অন্যান্য নিত্য খরচ মিটিয়ে দফতরগুলিকেও টাকা দিতে হবে। সিদ্ধান্ত এখনও চূড়ান্ত না-হলেও কলকাতা হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী ৩১% ডিএ বা মহার্ঘ ভাতা দিতে হলে সরকারের খরচ হতে পারে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। উপরন্তু আগামীবছরের জন্য রাজ্য বাজার থেকে প্রায় ৭৩,২৮৬ কোটি টাকা ধার নেবে। তার সুদ ও আসল মেটাতে ঘাড়ে রয়েছে প্রায় ৭০ কোটি টাকার বোঝা। তার উপরে স্বাস্থ্যসাথীর উপরে ‘জিএসটি-বোঝা’ চাপলে তা কতটা সামলানো যাবে, তা নিয়ে চর্চা জোরদার হচ্ছে প্রশাসনিক মহলে।