সে দিনের সেই ক্ষত সরিয়ে স্বামী-সন্তানহারা নবনীতা ফিরবেনই

২২ এপ্রিল। ছ’মাস আগের ওই তারিখ আমূল বদলে দিয়েছে কলকাতা পুরসভার সাত নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বাপি ঘোষের মেয়ে নবনীতার জীবন।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৮ ০৩:৫০
Share:

বাড়িতে নবনীতা। নিজস্ব চিত্র

শরীরে ২৬৪টি সেলাই। হাত, পায়ে প্লেট বসানো হয়েছে। হাঁটতে গেলে অন্যের সাহায্য নিতে হয়। এখনও সাড় না আসায় ডান হাতে কোনও কাজই করা যায় না। খাইয়ে দেন অন্য কেউ। তবে শারীরিক সে সমস্ত যন্ত্রণা ছাপিয়ে যা পড়ে রয়েছে, তা মানসিক ক্ষত। নিজের অস্তিত্বকে দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়া সেই ক্ষতের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছেন নবনীতা সাহা। প্রতি মুহূর্তে।

Advertisement

২২ এপ্রিল। ছ’মাস আগের ওই তারিখ আমূল বদলে দিয়েছে কলকাতা পুরসভার সাত নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বাপি ঘোষের মেয়ে নবনীতার জীবন। উৎসবের উদযাপন নিমেষে শোকে পাল্টে গিয়েছিল উলুবেড়িয়ায় পথ দুর্ঘটনায়। নবনীতা হারিয়েছিলেন স্বামী প্রীতম, একমাত্র সন্তান ছ’বছরের শিবম ও পরে মা মধুমিতা ঘোষকে। সকলে মিলে সেদিন মধুমিতাদেবীর জন্মদিন পালন করতে গিয়েছিলেন কোলাঘাটের একটি ধাবায়। ফেরার পথে দুর্ঘটনা।

দুর্ঘটনার পরে একাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছিল নবনীতার। তিনি বলছেন, ‘‘সে সময় কোনও জ্ঞান ছিল না আমার। যখন জ্ঞান ফিরেছিল, শুধু জানতে চাইতাম মায়েরা কেমন আছে। আমাকে বলা হয়েছিল ওদের খুব চোট লেগেছে।’’ স্বামী-সন্তান-মায়ের মৃত্যুর খবর তাঁকে দেওয়া হয়েছিল অনেক পরে, সাহায্য নেওয়া হয়েছিল মনোবিদের।

Advertisement

দুর্ঘটনা ঘটার মাত্র এক সপ্তাহ আগে নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছিল শিবম। মাত্র সাত দিন স্কুলে গিয়েছিল সে। সে-সব কথা পারতপক্ষে মনে করতে বা করাতে চান না কেউই। নবনীতার সামনেও কেউ শিবমের কথা সেভাবে উচ্চারণ করেন না। নবনীতা পুরনো অ্যালবাম দেখতে চাইলে অ্যালবাম থেকে আগে শিবমের ফটো সরিয়ে রাখা হয়। তার মধ্যেই আস্তে-আস্তে ফিরতে চাইছেন নবনীতা।

নবনীতা বলছেন, ‘‘ডাক্তাররা বলেছিলেন, আমার উঠে দাঁড়াতেই ছ’মাস লাগবে। তবে মনের জোরে অনেক দ্রুত সেরে উঠছি। কারণ, আমি শুনেছি একা দায়িত্ব নিয়ে আমার ভাই দাহ করেছিল তিন জনকে। বাবা এক সময় রাজনীতি ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। আমি বারণ করেছি। আমি জানি, আমার যেমন ওরা ছাড়া কেউ নেই, ওদেরও আমি ছাড়া আর কেউ নেই।’’

এখন প্রতিদিন সকালে ফিজিওথেরাপিস্ট আসেন। বেশ কিছুক্ষণ ব্যায়াম করেন নবনীতা। বিকেলে হাঁটতেও বলেছেন চিকিৎসক। তা সব সময় আর পেরে ওঠেন না নবনীতা। তার মধ্যেই নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা বিউটি পার্লারে একটু-আধটু যাতায়াত করেন। গিয়ে বসেন বাবার অফিসেও। নবনীতা চান, পুরোপুরি সুস্থ হয়ে রাজনীতিতে যোগ দিতে।

তবে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে স্মৃতি, প্রিয়জনদের সঙ্গে এক সঙ্গে কাটানো সময়। যেমন গত বছর পুজোর পরেই নবনীতারা ঠিক করে নিয়েছিলেন, এই বছরে পুজোতে কী-কী করবেন। কারণ, চলতি বছরে বাগবাজার সর্বজনীন ১০০ বছরে পড়েছে। আর বাগবাজারের পুজোতে নবনীতাদের পুরো পরিবার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নবনীতা বলছেন, ‘‘গত বছরের দশমী আমার কাছে স্পেশাল ছিল। সিঁদুর খেললাম। সকলে এক সঙ্গে ঘুরতে বেরলাম। এখন ভাবলে অবাক লাগে, সেটাই শেষবার ছিল!’’ দশমীর সেই ফটো ফেসবুক প্রোফাইলে জ্বলজ্বল করছে। এখনও! তবে সে-সব আর দেখেন না নবনীতা।

বাগবাজারের পুজোর উদ্বোধন হয়ে গিয়েছে আগেই। বাড়ি থেকে অনেকবার তাঁকে মণ্ডপে যেতে বলা হয়েছে। কিন্তু নবনীতা যেতে রাজি নন। বলছেন, ‘‘পুজোটা কিছুতেই ফেস করতে পারব না। বেশি ক্ষণ কিছুই ভাল লাগে না। বই পড়া, গান, কিচ্ছু না।’’

নিজের মেয়েকে নিয়ে বাপিবাবু বলছেন, ‘‘রাস্তায় হাঁটছে হয়তো। কয়েকটা বাচ্চাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। আর সরছে না। তখন সেখান থেকে সরিয়ে আনতে হয়। সকলের সাথে যত মেলামেশা করবে, ততই বেরিয়ে আসতে পারবে ওই ট্রমা থেকে।’’ নবনীতার ভাই সুরজিৎ ঘোষ বলছেন, ‘‘ও দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরুক, এটাই চাইছি আমরা সকলে।’’আর নবনীতা বলছেন, ‘‘স্বাভাবিক জীবনে ফেরাটা আমার কাছে চ্যালেঞ্জ। শুধু নিজের জন্যই নয়, পরিবারের সকলের জন্য। মনের জোরে ফিরে আসতে চাই।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement