সৎকারের সময় সমাপ্তি রুইদাসের বাঁ হাতে এই লেখা দেখতে পান তাঁর আত্মীয়স্বজন। তাঁদের দাবি, এই লেখা সমাপ্তির নয়। নিজস্ব চিত্র
নার্সিংয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী সমাপ্তি রুইদাসের সইহীন ‘সুইসাইড নোট’ হিসেবে যে-চিরকুটের কথা বলা হচ্ছে, সেটিতে ইংরেজিতে অস্বাচ্ছন্দ্যের কথা আছে। ইংরেজি-ভীতি থেকেই ওই ছাত্রী আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য ভবনের কিছু কর্তা। কিন্তু রবিবারেও সমাপ্তির অপমৃত্যুতে বেশ কিছু ‘খটকা’ দেখছেন তাঁর আত্মীয়বন্ধুদের অনেকে। খটকা বেশি র্যাগিংয়ের অভিযোগ ঘিরে। সমাপ্তি বাঁকুড়ার কোতুলপুরের মেয়ে। সেখানকার বিধায়ক, পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী শ্যামল সাঁতরাও বলেন, ‘‘পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হচ্ছে, হস্টেলে ওর উপরে র্যাগিং হত। প্রকৃত তদন্ত হওয়া দরকার।’’
শ্যামলবাবু এ দিন সমাপ্তিদের বাড়িতে যান। তিনি বলেন, ‘‘বাড়ির লোকজন অভিযোগ করছেন, অত্যাচার করেই মেয়েটিকে এই পথে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। যাতে প্রকৃত তদন্ত হয়, আমি সেই চেষ্টাই করব।’’
শনিবার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের পাঁচতলার বারান্দায় সমাপ্তির ঝুলন্ত দেহ পাওয়া যায়। এই অপমৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গড়া হয়েছে বলে জানান হাসপাতালের সুপার সন্দীপ ঘোষ। ওই ছাত্রীর বাবা সুকুমার রুইদাস বলছেন, ‘‘আলাদা ভাবে কোনও অভিযোগ দায়ের করব না। তবে আমি সত্যিটা জানতে চাই।’’ শনিবার রাতে সমাপ্তির দেহ ফেরে গ্রামের বাড়িতে। সুকুমারবাবু জানান, সৎকারের সময় তাঁরা দেখেন, মেয়ের বাঁ হাতে লেখা রয়েছে: ‘আমার বালিশের তলার খাতার ফোল্ড করা পাতায় লেখা আছে’। কিন্তু সেই হাতের লেখা সমাপ্তির নয় বলেই জানান বাবা। সমাপ্তির কাকা উজ্জ্বল রুইদাসের অভিযোগ, ‘‘ওর চোখের কাছে মারের দাগ দেখেছি।’’
আরও পড়ুন: কেন্দ্রীয় শর্তে রাজ্যে আটকে জল প্রকল্প
মেয়ের অপমৃত্যুর খবর পেয়ে কলকাতায় চলে আসেন সুকুমারবাবু। তিনি বলেন, ‘‘কলেজ থেকে আমাদের বলা হল, ‘এই রেলিংয়ে ঝুলে পড়েছিল। আপনি মর্গে চলে যান। ওখান থেকে লাশ নিয়ে বাড়ি চলে যাবেন।’ সুইসাইড নোট কিংবা অন্য কিছু আমরা চোখেও দেখিনি।’’
তাজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে সমাপ্তির দুই সহপাঠী জানান, হস্টেলে র্যাগিং হত বলে ওই তরুণী তাঁদের কাছে অভিযোগ করেছিলেন। তাঁরা বলেন, ‘‘রাতে আলো জ্বালিয়ে পড়তে পারত না। মাঝরাতে সিনিয়রেরা পড়া ধরতে আসত। না-পারলে পাঁচতলা থেকে একতলায় পাঁচ-ছ’বার ওঠানামা করাত। পোশাক খুলে মারধরও করা হত।’’ স্কুলের এক সহপাঠী বলেন, ‘‘নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে হয়তো অসুবিধা হতে পারে। কিন্তু ভর্তির মাত্র এক মাসের মধ্যে কতটা পড়ার চাপ পড়া সম্ভব? আমরা আত্মহত্যার কথা মানতে পারছি না।’’ স্বাস্থ্য ভবনের আধিকারিকদের একাংশের বক্তব্য, হস্টেলগুলিতে এখন আর ‘সে-ভাবে’ র্যাগিং হয় না। যদিও নার্স সংগঠনগুলির সদস্যদের পর্যবেক্ষণ, বিভিন্ন বিষয়ে সিনিয়রেরা জুনিয়রদের বিচারসভা বসাচ্ছেন— এমন খবর তাঁদের কাছেও আসে।
ইংরেজি-ভীতি প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ভবনের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘প্রথম বর্ষের এই অসুবিধা দ্বিতীয় বর্ষে ঠিক হয়ে যায়। একটু ধৈর্য ধরলে এটা হত না। এই প্রজন্মের সেটারই অভাব!’’ স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, এ বছর নার্সিংয়ে ২৪০০ জন ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের অনেকেরই অ্যানাটমি, ফিজিয়োলজি, ফার্স্ট এড, নিউট্রিশনের মতো বিষয় ইংরেজিতে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে বলে শিক্ষকদের কাছ থেকে জানতে পারছে স্বাস্থ্য ভবন। এই অবস্থায় নার্সিংয়ের শিক্ষকদের প্রথম বর্ষে বেশি সময় ধরে ক্লাস নিতে হচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে। জানানো হয়েছে, পাঠ্যক্রমের চাপ সহ্য করতে না-পেরে অন্তত পাঁচ জন ছাত্রী বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। প্রতি বছর এই সংখ্যাটা ১৫-২০ হয়ে যায়।
হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের দাবি, সমাপ্তির ঘরে পাওয়া সুইসাইড নোটে লেখা ছিল, নার্সিংয়ের পঠনপাঠন ইংরেজিতে চলায় তিনি মানসিক চাপে ছিলেন। তবে নার্সেস ইউনিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদিকা ভাস্বতী মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘বাংলা মাধ্যম থেকে আসায় ইংরেজিতে কথা বলতে অসুবিধা হতে পারে। কিন্তু পড়ে বুঝব না কেন! পরিবারের অভিযোগও মারাত্মক। প্রকৃত তদন্ত হওয়া উচিত।’’