সন্তোষবাবুর শেষযাত্রা। সাঁকরাইলের ভান্ডারীপাড়ায়। নিজস্ব চিত্র
ক’দিন আগেও এলাকায় অশান্তির আবহ ছিল। এখনও ১৪৪ ধারা আছে। পুলিশের ভারী বুটের শব্দ আছে। তার মধ্যেও বৃদ্ধ সন্তোষ কর্মকারকে বাঁচাতে লড়ে গিয়েছিলেন ওঁরা। এমনকি, তাঁর শেষযাত্রাতেও সঙ্গী হলেন। চাঁদা তুলে সমস্ত খরচ তো বহন করলেনই, খই ছড়ানো থেকে হরিধ্বনি দিতে দিতে বৃদ্ধের দেহ শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহকাজের সব আয়োজনেও হাত লাগালেন।
ওঁরা— মানে সোহরাব সর্দার, মোস্তাক আলি মোল্লা, ফিরোজ মল্লিক, শেখ আসাদুল, সইদুল মল্লিক, হাসানুর রহমানেরা। হাওড়ার সাঁকরাইলের ভান্ডারীপাড়ায় ওঁদের বসবাস। বছর পঁচাত্তরের সন্তোষবাবু ওঁদের পড়শি। সন্তোষবাবুর ছেলে মাধব বন্ধু। এলাকায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষই বেশি। দু-চারটি হিন্দু পরিবার আছে।
পয়গম্বরকে নিয়ে বিজেপির মুখপাত্র (এখন সাসপেন্ডেড) নূপুর শর্মার আপত্তিকর মন্তব্যের প্রতিবাদে গত সপ্তাহে অবরোধ-গোলমালে তিন দিন ধরে হাওড়ার যে সব জায়গায় উত্তেজনা ছড়িয়েছিল, তার মধ্যে ছিল সাঁকরাইলও। ভান্ডারীপাড়ায় কোনও গোলমাল না হলেও শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা বাবাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন মাধব। গত মঙ্গলবার সন্তোষবাবুর অসুস্থতা বাড়ে। সোহরাব ও মোস্তাক আলির সাহায্যে তাঁকে কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি করান মাধব। বন্ধুর বাবার জন্য মোস্তাক রক্তও দেন।
কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। বৃহস্পতিবার সকালে সন্তোষবাবু মারা যান। অথৈ জলে পড়েন মাধব। তিনি গৃহশিক্ষকতা করেন। মা আছেন। ধারে-কাছে আত্মীয়-স্বজন বিশেষ নেই। কী করে বাবার সৎকার করবেন? হাতে টাকাও বেশি নেই। এ ক্ষেত্রেও মুশকিল আসান হলেন সোহরাব, মোস্তাক আলিরা। সন্তোষবাবুর মৃত্যুর খবর গ্রামে পৌঁছতেই হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে করে দেহ ফেরালেন ওঁরা।
তত ক্ষণে মাধবের বাড়িতে চলে এসেছেন তাঁর এক মামা ও মাসি-মেসোমশাই। তাতে সরে যাননি সইদুল, ইমরান, সুরজ, আরফাদরা। চাঁদা তুলে তাঁরা গীতা, নামাবলি থেকে শেষযাত্রার যাবতীয় জিনিস কিনে আনেন। নিজেদের বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে খাটিয়া তৈরি করেন। তাঁদের পরিবারের মহিলারা এসে সন্তোষবাবুর স্ত্রী আরতিদেবীকে সামলাচ্ছিলেন। এমনকি, হিন্দু রীতি মেনে তাঁকে শেষবারের মতো আলতা-সিঁদুর পরিয়ে দেন ফাতেমা বিবি ও মোসলেমা মিদ্দেরা।
মাধবের বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে শ্মশান। সইদুল-ইমরানরাই কাঁধে তুলে সন্তোষবাবুর দেহ শ্মশানে নিয়ে যান। সব কাজ শেষ করে সইদুল-ইমরানদের সঙ্গেই বাড়ি ফেরেন মাধব। সদ্য পিতৃহারা হওয়ার শোক আছে। তার মধ্যেও মাধবের মুখে বারবার এসেছে সইদুল-ফিরোজদের অবদানের কথা। তিনি বলেন, ‘‘চারদিকে যখন ধর্মের নামে অশান্তি চলছে, মানুষ বাইরে বার হতে ভয় পাচ্ছেন, তখন যে ভাবে প্রতিবেশী মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ পাশে দাঁড়িয়েছেন, ভোলার নয়। সব খরচ ওঁরাই করেছেন।’’
সোহরাবেরা এর মধ্যে বিরাট কোনও কৃতিত্ব দেখছেন না। তাঁরা জানান, বিপদে বন্ধুর পাশে দাঁড়িয়েছেন মাত্র। সোহরাবের কথায়, ‘‘ছোট থেকে এক গ্রামে মানুষ হয়েছি। একসঙ্গে খেলাধুলো করেছি। মাধবের বাবা অসুস্থ হওয়ায় গ্রামের ছেলেদের নিয়ে ওঁর পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। এলাকায় অশান্তি হলেও গ্রামের কেউ যুক্ত ছিলেন না। শ্মশানযাত্রার ব্যবস্থাপনার জন্য পুলিশের অনুমতি নিয়েছিলাম। পুলিশ আমাদের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানায়।’’
হাওড়া সিটি পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘মানুষের মধ্যে শান্তি আনতে গেলে এমনই সম্প্রীতি দরকার। সাঁকরাইলের ভান্ডারীপাড়া করে দেখালো।’’ সাঁকরাইলের বিধায়িকা প্রিয়া পাল ঘটনার কথা শুনেছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমার বিধানসভা এলাকায় এমন ঘটনায় গর্ববোধ করছি। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুক এই সম্প্রীতির বার্তা।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।