ফুটপাথের ওপরে ঝুপড়ি দোকানটায় মাথা গলাতেই হাঁ হাঁ করে উঠলেন ভেতরের দোহারা চেহারাটি। “আজ আর কিচ্ছু জিজ্ঞেস করবেন না দাদা। বোঝেনই তো আমাদের অবস্থাটা!”
সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সের সামনে খবরের খোঁজে গত ক’মাস ধরে হাজিরা দেওয়া সাংবাদিকেরা প্রায় সকলেই তাঁদের মুখচেনা। সেই আলাপের সূত্রেই গত ১৫ জানুয়ারি আনন্দবাজারের প্রতিনিধির কাছে এই খাবারের দোকানটির মালিক ও তাঁর কয়েক জন সতীর্থ দুঃখ করেছিলেন যে, তাঁদের বড় ক্ষতি হয়ে গেল। আসলে ধরে নিয়েছিলেন, মুকুল রায় সে দিনই হাজিরা দিতে আসবেন সিবিআই দফতরে। বাইরে জমবে ভিড়। আগের রাত থেকে জোগাড় করে ফেলেছিলেন বাড়তি ভাত-রুটি-ডিম-ঘুগনি। মুকুল সে দিন আসেননি। খাবারও নষ্ট হয়েছিল অনেক।
কিন্তু এ দিন তো সিজিও কমপ্লেক্সের বাইরে সাতসকাল থেকে ভিড়। সেই ভিড়ের অনেকেই গুটিগুটি ঢুকে পড়ছেন নানা দোকানে। স্বভাবতই আগের দিনের মনমরা দোকানিদের কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা গিয়েছিল। কিন্তু শুক্রবার তাঁরা কেউই মুখ খুলতে নারাজ। দোকানির নাম ও তাঁর বিক্রি করা খাবারের নাম গোপন রাখার শর্ত মেনে শুধু এটুকু জানা গেল, এ দিনও বাড়তি খাবারের ব্যবস্থা ছিল। বিক্রিও মন্দ হয়নি।
অর্থাৎ, ভিড় টেনে এনে ‘কথা রেখেছেন’ মুকুল রায়। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর যেমন রেখেছিলেন মদন মিত্র। তিনি আসার দিনেও ভিড় হয়েছিল বিস্তর। পার্থক্য একটাই। সিবিআইয়ের সামনে প্রথম হাজিরার দিনেই গ্রেফতার হয়ে যান মদন।
ভুল হল। পার্থক্য তো ভিড়েও।
কোন দিন বেশি ভিড় ছিল, তা নিয়ে তুল্যমূল্য বিচার চলবেই। কিন্তু মদনের দিন ভিড়ে ঘাসফুল আঁকা উড়ন্ত তেরঙ্গা পতাকা ছিল। ‘মমতা ব্যানার্জি জিন্দাবাদ’ স্লোগান ছিল। আর এ দিন? সেই পতাকাও নেই, স্লোগানও নেই। কেন?
জনাকয়েক অনুগামীকে প্রশ্নটা করা গিয়েছিল। শোনা গেল নানা যুক্তি। কেউ বললেন, “দাদাদের নিষেধ ছিল।” কেউ জানালেন, দলের পক্ষ থেকে নয়, মুকুলদার টানেই এসেছেন। এক নেতা আবার বললেন, “সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তদন্ত হচ্ছে। বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া যায় না। তদন্তে সাহায্য করতে এসেছেন মুকুলদা। বিশৃঙ্খল আচরণ করলে তা তদন্তের বিরুদ্ধে যাবে।”
তবে এ যাত্রা ‘মুকুলদা’ নিজেই কর্মী-সমর্থকদের আগাম বার্তা দিয়ে রেখেছিলেন ‘অপ্রিয়’ কিছু ঘটে গেলে কেউ যেন অশান্তি না করে। সম্ভবত তাই সিজিও কমপ্লেক্সের বাইরে প্রবল উৎকণ্ঠা চেপে অথচ ভীষণ ধৈর্য ধরে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল ভিড়টা (এর সঙ্গে অবশ্যই মুকুল এসে পৌঁছনোর আগে ও জেরা শেষে বেরিয়ে আসার পরের সময়টাকেও যোগ করতে হয়)। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি ও ঘিয়ে রঙের শাল জড়ানো তৃণমূল নেতা যখন সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ সিজিও কমপ্লেক্সের সামনে নামলেন, তখনই সেখানে উপচে পড়া ভিড়। প্রায় দেড়শো মিটার হেঁটে এসে ভেতরে ঢুকে পড়লেন মুকুল। বেলা যত বাড়ল, ভিড় ক্রমশ থিকথিকে হল। এক সময়ে সামনের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিতে হল পুলিশকে।
কাঁচরাপাড়া, দমদম, বাদুড়িয়া, ব্যারাকপুর থেকে আসা মুকুল-ভক্তরা অবশ্য ফুটপাথের দোকানিদের মতো মুখে কুলুপ আঁটেননি। বরং মদনের মতো মুকুলকেও জেরার প্রথম দিনেই গ্রেফতার করা হবে কি না, সাংবাদিক দেখলেই টেনশন-থরথর গলায় অনেকে জানতে চাইছিলেন। যেমন ব্যারাকপুরের তমাল রায়। বাদুড়িয়ার কাঞ্চন সাহার অভিযোগ, তাঁদের ‘প্রাণভোমরা’কে হেনস্থা করে তৃণমূলের ক্ষতি করতে চাইছে বিজেপি। এক জন আবার ‘চ্যালেঞ্জ নিবি না’ মেজাজে “মুকুলদা কী মাপের নেতা, আজ সিবিআই টের পাবে!”
বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ তাঁরাই অবশ্য টের পেলেন, ‘মুকুলদা’ আপাতত ফাঁড়া কাটিয়ে উঠেছেন। দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, তিনতলায় সিবিআই দফতর থেকে একতলায় নেমে এসে মিটিমিটি হাসছেন তিনি। মুহূর্তে ঝড় বইল। কয়েকশো বুক খালি করে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল যে!
দরজার বাইরে সংবাদমাধ্যমের ঠেলাঠেলি। মুকুলও চাইছেন কথা বলতে। তাঁকে বলা হল, অদূরে সুইমিং পুলে গিয়ে বরং সাংবাদিক বৈঠকটা করা হোক। কিন্তু মুকুল একটু ভেবে নিয়ে বললেন, “সরকারি জায়গায় আমি সাংবাদিক বৈঠক করলে আবার নতুন বিতর্ক হবে।” সঙ্গে থাকা বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত প্রস্তাব রাখলেন, সুইমিং পুলের বাইরে মঞ্চতেও সাংবাদিক বৈঠক করা যেতে পারে। শেষমেশ সিজিও কমপ্লেক্স চত্বরেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বললেন মুকুল। তার পর গেলেন মঞ্চে। সেখানেই তখন ছেলে শুভ্রাংশু, বিধায়ক শিউলি সাহা, পরেশ পাল, শঙ্কুদেব পণ্ডা-সহ অনেকে। মুকুল ভিজলেন ফুলের পাপড়িতে।
সিবিআই দফতরের সামনে থেকে তখন পাতলা হচ্ছিল ভিড়। মলিন একটি মুখ তখনও দাঁড়িয়ে। জেলবন্দি পরিবহণমন্ত্রীর এই একনিষ্ঠ ভক্তের গলায় কটাক্ষের সুর, “বাহ! মদনদাকে ধরল। আর মুকুলদাকে ছেড়ে দিল!”