মুকুল রায়। ফাইল চিত্র।
মুকুল রায় তৃণমূলে ফিরে যাওয়ার পর তাঁর ঘনিষ্ঠেরা দাবি করেছিলেন, তিনি ‘নৈতিক কারণে’ বিজেপি-র টিকিটে জেতা কৃষ্ণনগর উত্তরের বিধায়ক পদ ছেড়ে দেবেন। তাঁর বিধায়কপদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার সম্ভাবনার কথা সেদিনই লিখেছিল আনন্দবাজার ডিজিটাল। তবে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর শীর্ষনেতৃত্বের নির্দেশে সেই সিদ্ধান্ত বদলেছে। যতক্ষণ না শীর্ষনেতৃত্ব নির্দেশ দিচ্ছেন, ততক্ষণ মুকুল বিধায়কই থাকছেন। তার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, নতুন বিধানসভার যে সব কমিটি গঠিত হবে, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পিএসি (পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি)-র চেয়ারম্যান করা হতে পারে মুকুলকে। বিধানসভার রীতি অনুযায়ী তা একেবারে অসম্ভব নয় বলেও অভিমত অভিজ্ঞ এবং প্রবীণ বিধায়কদের।
তৃণমূলের এক প্রবীণ নেতার কথায়, ‘‘দেখা যাক না, বিজেপি কী করে! আমরা ঠিক করেছি, সম্মুখ সমরে যাব। বিজেপি কোনও নীতি-নৈতিকতার ধার ধারে না। তা হলে আমরা কেন নৈতিকতা দেখাতে যাব? দেখা যাক, মুকুল নিয়ে বিজেপি কতদূর যায়!’’ বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অবশ্য সোমবারেই জানিয়েছেন, তাঁরা বুধবারেই স্পিকারের কাছে মুকুলের বিরুদ্ধে দলত্যাগ বিরোধী আইন কার্যকর করার দাবি করবেন। তৃণমূল সূত্রের খবর, দলীয় স্তরে মুকুলকে পিএসি চেয়ারম্যান হিসেবে এগিয়ে দেওয়ার ভাবনাচিন্তা শুরু হলেও এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। পুরো বিষয়টিই আপাতত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবেচনাধীন। তিনি সবুজ সঙ্কেত দিলে তবেই বিষয়টি নিয়ে আরও গুরুত্ব দিয়ে এগোন হবে। তার আগে এ-ও দেখে নেওয়া হবে যে, বিজেপি মুকুল নিয়ে কতদূর যাচ্ছে।
দলত্যাগ বিরোধী আইন অনুযায়ী কোনও বিধায়ক বা সাংসদের সদস্যপদ খারিজ করার বিষয়ে চূড়ান্ত ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে সংশ্লিষ্ট আইনসভার স্পিকারকে। কবে, কার বিরুদ্ধে দলত্যাগ বিরোধী আইন কার্যকরের পদক্ষেপ করবেন বা আদৌ করবেন কি না, সবেরই শেষ কথা তিনি। তাই মুকুলকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ইস্তফা দিতে বলছে না তৃণমূল। স্পিকার পদক্ষেপ না করলে খাতায়কলমে বিজেপি-র বিধায়ক থেকেও তিনি সভার বাইরে তৃণমূল থাকতে পারবেন। এমন উদাহরণ রাজ্যে এবং দেশে ভূরি ভূরি রয়েছে।
দলত্যাগ বিরোধী আইন কার্যকর করার মতো পিএসি-র চেয়ারম্যান মনোনীত করার অধিকারও স্পিকারের হাতেই। সাধারণত ওই কমিটির প্রধান হয়ে থাকেন বিরোধী দলের মনোনীত বিধায়ক। কিন্তু সেটি কোনও আইনসিদ্ধ বিষয় নয়। রেওয়াজ মাত্র। বিরোধী দল থেকেই পিএসি-র চেয়ারম্যান করতে হবে, এমন কোনও বিধি নেই বিধানসভার আইনে। শাসকদলের বিধায়কেরই ওই কমিটির চেয়ারম্যান থাকার নজিরও দেশে রয়েছে। হরিয়ানায় মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টরের বিজেপি সরকার চললেও সেখানে বিধানসভায় পিএসি-র চেয়ারম্যান গেরুয়া শিবিরেরই বিধায়ক। এ নিয়ে কংগ্রেস দাবি জানালেও তা মেনে নেননি স্পিকার জ্ঞানচাঁদ গুপ্ত।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় মোট ৪১টি কমিটি রয়েছে। যার মধ্যে ২৬টি স্ট্যান্ডিং কমিটি এবং ১৫টি অ্যাসেম্বলি কমিটি। একটা সময় পর্যন্ত খবর ছিল, শাসক তৃণমূলের পরিষদীয় দল ১০টি কমিটির শীর্ষপদ বিজেপি-কে ছাড়তে পারে। এর মধ্যে পিএসি থাকবে বলেও শোনা গিয়েছিল। কিন্তু বিধানসভার একটি সূত্রেক দাবি, তৃণমূল ওই কমিটির চেয়ারম্যান পদে মুকুলকে বসানো নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে।
নিয়ম অনুযায়ী, বিধানসভার ৪১টি কমিটির মধ্যে পিএসি-সহ চারটির সদস্য হন বিধায়কদের ভোটে ‘নির্বাচিত’ বিধায়করা। বাকি তিনটি কমিটি হল পাবলিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং কমিটি (পিইউসি), এস্টিমেট কমিটি (ইসি) এবং লোকাল ফান্ড কমিটি (এলএফসি)। বিধায়কদের ভোটে নির্বাচিত বিধায়কদের মধ্যে থেকে ওই চার কমিটির চেয়ারম্যান ঠিক করেন স্পিকার। সুতরাং, চেয়ারম্যান মনোনয়ন রয়েছে বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। সূত্রের দাবি, তৃণমূল চাইছে চারটি কমিটির মাথাতেই থাকুন তাদের দলের বিধায়ক। মুকুল খাতায়কলমে বিজেপি-র বিধায়ক হলেও তিনি এখন সর্বার্থেই তৃণমূলের।
এখানে প্রশ্ন, বিজেপি তো মুকুলের নাম দেবে না। তা হলে তিনি কী ভাবে প্যানেলে নির্বাচিত হবেন। নিয়ম অনুযায়ী, ওই চারটি কিমটির সদস্য হওয়ার জন্য নির্বাচনে লড়তে গেলে কোনও বিধায়ককে একজন প্রস্তাবক ও একজন প্রস্তাবের সমর্থক দরকার। বিজেপি কোনও ভাবেই মুকুলের জন্য প্রস্তাবক বা প্রস্তাবের সমর্থক দেবে না। তবে তৃণমূলের এক প্রবীণ বিধায়কের মতে, তৃণমূলের কোনও দুই বিধায়ক সেই কাজ করতে পারেন। পাশাপাশিই তাঁর বক্তব্য, ‘‘মুকুলের পরে বিজেপি-র টিকিটে জয়ী আরও কয়েকজন বিধায়ক তৃণমূলে যোগ দেওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন প্রস্তাবক এবং একজন সেই প্রস্তাবের সমর্থক হতেই পারেন। তার পর তাঁদের বিরুদ্ধে দলত্যাগ বিরোধী আই আনা হতে পারে ঠিকই। কিন্তু সেটা তখন দেখা যাবে। মুকুলের বিরুদ্ধেও তো দলত্যাগ বিরোধী আইন আনার কথা বলছে বিজেপি।’’
শেষ পর্যন্ত মমতা অনুমতি দিলে মুকুলকে পিএসি চেয়ারম্যান করার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাববে তৃণমূল। কিন্তু তার আগে তারা দেখে নিতে চায়, বিজেপি মুকুলের বিরুদ্ধে দলত্যাগ বিরোধী আইন প্রণয়ন নিয়ে কতদূর যায়। তার উপরেই নির্ভর করছে মুকুল এবং পিএসি চেয়ারম্যান ভবিষ্যৎ সম্পর্ক।