নুসরতের এই ‘তৎপরতা’ কি আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনের জন্য? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পাঁচ বছরেরও বেশি সময় বসিরহাট কলেজে কোনও ‘নবীনবরণ উৎসব’ হয়নি। বৃহস্পতিবার সেই উৎসব। তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-এর নামে আয়োজিত হলেও সমস্ত উদ্যোগ স্থানীয় সাংসদ নুসরত জাহানের। পদাধিকার বলে তিনি ওই কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতিও বটে।
নবীনবরণের প্রস্তুতিতে বেশ কিছু দিন ধরেই ব্যস্ত ছিলেন অভিনেত্রী-সাংসদ নুসরত। বেশ কয়েক বার কলেজের টিএমসিপি নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকও করেন তিনি। তবে বিজেপি প্রত্যাশিত ভাবেই তৃণমূল সাংসদকে কটাক্ষ করছে। তাদের দাবি, এলাকায় কাজের সময় নুসরতকে পাওয়া যায় না। আগামী বছর লোকসভা ভোটে নিজের টিকিটটি বসিরহাট থেকে ‘নিশ্চিত’ করতেই তিনি ‘ময়দানে’ নেমেছেন। তৃণমূলের যদিও পাল্টা দাবি, বিজেপির ‘স্মৃতিশক্তি’ অত্যন্ত দুর্বল। সে কারণেই কিছু মনে রাখতে পারে না গেরুয়া শিবির। নুসরতকে সমস্ত বিষয়েই এলাকার মানুষ কাছে পান বলেই ঘাসফুল শিবিরের দাবি।
এই ‘তৎপরতা’ কি আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনের জন্য? নুসরত যদিও বলছেন, ‘‘একেবারেই না। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। কোভিডের জন্য বেশ কয়েক বছর নবীনবরণ হয়নি। কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরাই সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাদের আবদার মেনেই এই উদ্যোগ। কলেজের পরিচালন সমিতির প্রেসিডেন্ট হিসেবেই উদ্যোগী হয়েছি। বসিরহাটের সাংসদ হিসাবে নয়।’’
ঘটনাপ্রবাহ বলছে, ২০১৯-এর নির্বাচনে রাজ্যে শাসক দলের জয়ীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোটে জিতেছিলেন নুসরত। বসিরহাট কেন্দ্রে তিনি সাড়ে তিন লাখেরও বেশি ভোটে জেতেন। কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী সময়ে মাঝে অভিযোগ উঠেছিল, সাংসদকে এলাকায় দেখা যায় না। গত বছরের মে মাসে বসিরহাটে তাঁর নামে ‘নিখোঁজ’ পোস্টার পড়ে। সেখানে লেখা, ‘বসিরহাটের এমপি নুসরত জাহান নিখোঁজ, সন্ধান চাই।’ বেশির ভাগ পোস্টারের নীচেই লেখা ছিল, ‘প্রচারে তৃণমূল’। স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব এ নিয়ে সেই সময় আনুষ্ঠানিক ভাবে মুখ খোলেননি। তবে দলের একটা অংশ মেনে নিয়েছিলেন, দলীয় সাংসদকে এলাকায় নিয়মিত দেখতে না-পাওয়ার কারণেই ওই পোস্টার পড়েছিল। সেই নুসরতই বসিরহাট কলেজের নবীনবরণ উৎসব উপলক্ষে দৌড়ে বেড়িয়েছেন। নানাবিধ পরিকল্পনা, আলোচনা ও বৈঠক করেছেন।
কলেজের টিএমসিপি নেতৃত্ব জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার, বসিরহাট কলেজের নবীনবরণ উৎসবে গান গাইতে আসছেন মিকা সিংহ। সঙ্গে থাকবে মীরের ব্যান্ড ‘ব্যান্ডেজ’। অনুষ্ঠানের পরিকল্পনায় সাংসদ-অভিনেত্রী নুসরত। বসিরহাট দক্ষিণের বিধায়ক সপ্তর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘প্রত্যেক কলেজে একটি পরিচালন সমিতি থাকে। আমাদের কলেজে মাননীয় সাংসদ সেই পরিচালন সমিতির সভাপতি। তাঁর উদ্যোগে বহু বছর পর কলেজে এমন একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। পড়ুয়ারা অত্যন্ত খুশি। আমরা যারা পরিচালন সমিতির সদস্য, তারাও খুব আনন্দিত। দীর্ঘ সময় পর ছাত্রছাত্রীদের আনন্দ উৎসবের একটা পরিসর তৈরি হয়েছে কলেজে।’’
কলেজের নবীনবরণ নিয়ে গত কয়েক দিনে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছেন নুসরত। সেখানে ডাক পেয়েছিলেন বসিরহাট পুরসভার চেয়ারম্যান অদিতি মিত্র। তাঁর দাবি, শুধু কলেজ নয়, গোটা এলাকার মানুষ আগ্রহভরে বৃহস্পতিবারের নবীনবরণের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। অদিতির কথায়, ‘‘কলেজে দীর্ঘ দিন পর নবীনবরণ হচ্ছে। মিকা সিংহ গাইবেন। মাননীয়া সাংসদ আমাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন নিয়মিত। সকলে মুখিয়ে রয়েছেন অনুষ্ঠান দেখার জন্য।’’
১৯৪৭ সালে স্থাপিত বসিরহাট কলেজে ছাত্র সংসদের শেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৬ সালে। জিতেছিল টিএমসিপি। কলেজের ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক তথা স্থানীয় তৃণমূল নেতা বাদল মিত্র জানাচ্ছেন, বসিরহাট কলেজ দীর্ঘ দিন ধরেই টিএমসিপির দখলে। তিনি বলেন, ‘‘১৯৮৪ সাল থেকে এই কলেজ ছাত্র পরিষদের। ১৯৯৮ থেকে ২০১৬— মাঝে তিন বছর বাদ দিয়ে প্রতি বারই টিএমসিপি ক্ষমতায়। ২০০১, ’০২ এবং ’০৩ এই তিন বছর এসএফআই জিতেছিল। নবীনবরণ আমাদের কলেজের একটা ঐতিহ্য। কিন্তু ২০১৭ সালের পর আর এই কলেজে আর নবীনবরণ হয়নি। এ বার সাংসদের উদ্যোগে ধুমধাম করেই হচ্ছে।’’
নুসরতের এই উদ্যোগ নিয়ে যদিও কটাক্ষ করেছে গেরুয়া শিবির। বিজেপির বসিরহাট সাংগঠনিক জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষের বিপদেআপদে উনি কোনও কাজে লাগেন না। বসিরহাটে উনি আসেনও না। লোকে খুঁজে বেড়ায়। এলাকায় হাজারো সমস্যা। ওঁর যদিও এ নিয়ে ধ্যানজ্ঞান নেই। উনি মাঝে মাঝে আসেন। এই খেলা, মেলা, নবীনবরণ করে বেড়ান। সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে উনি নেই। এ জন্য তৃণমূলকর্মী থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই ওঁর উপর ক্ষুব্ধ।’’ বিজেপির দাবি, লোকসভা নির্বাচন এগিয়ে আসছে বলেই নুসরত আবারও তৃণমূলের টিকিট ‘নিশ্চিত’ করতে এমন ‘কোমরবেঁধে’ নেমেছেন।
বিজেপির এই দাবি যদিও উড়িয়ে দিচ্ছেন বাদল। তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন নুসরতের ভোটে জেতার অঙ্ক। বাদলের কথায়, ‘‘২০১৪ সালের নির্বাচনে বসিরহাটের তৃণমূল প্রার্থী ইদ্রিস আলি পেয়েছিলেন ৩৮.৬৫ শতাংশ ভোট। ২০১৯ সালে নুসরত পেয়েছিলেন ৫৪.৫৬ শতাংশ ভোট। নুসরত সাড়ে তিন লাখেরও বেশি ভোটে জিতেছিলেন। বিজেপির স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত দুর্বল। ওরা কিছুই মনে রাখতে পারে না।’’ একই সঙ্গে বাদলের দাবি, ‘‘মাঝের অনেকটা সময় অতিমারি পর্ব গিয়েছে। সাংসদ কী করেছেন, তা এলাকার মানুষজন জানেন। বিজেপির কাছ থেকে ওঁরা সেটা জানতে যাবেন না।’’