প্রায় এক যুগ হয়ে গেল আমি তুরস্কে রয়েছি। ছবি: এএফপি।
টিভির দিকে তাকাতেই পারছি না। বন্ধ করে রাখছি। গত ১১ বছর ধরে যে দেশে আমি থাকি, ক্রিকেটে যে দেশের প্রতিনিধিত্ব করি, সেটা এ ভাবে দুমড়েমুচড়ে গিয়েছে! এত মৃত্যু! এত অসহায়তা! এত ভাঙাচোরা! বিশ্বাস হচ্ছে না, এই ধ্বংস উপত্যকায় আমি বেঁচে আছি!
সোমবার যে সময়টায় ভূমিকম্প হয়, তুরস্কে তখন ভোর। ঘুম ভাঙেনি কারও। ঘুমের মধ্যেই হাজার হাজার মানুষ ‘চির ঘুমে’ চলে গেল! পলক খোলার আগেই। এই যে বেঁচে আছি, আশ্চর্য লাগছে! খুব বেমানান লাগবে হয়তো, তা-ও আনন্দবাজার অনলাইনের জন্য এ লেখা লিখতে গিয়ে প্রথমেই বলতে চাই, ভাল আছি। কেন জানেন? মাথার উপর ছাদ রয়েছে। দু’বেলা সপরিবার খেতে পাচ্ছি। এটাই অনেক। কারণ, তুরস্কের একটা অংশের মানুষের কাছে আজ এ দুটোর কোনওটাই নেই।
তুরস্কের রাজধানী ইস্তানবুল। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সপরিবার এই শহরেই থাকি। এখানে ভূমিকম্পের কোনও প্রভাব পড়েনি। সোমবার ঘুম থেকে ওঠার পরে জানতে পেরেছিলাম, কী ঘটে গিয়েছে দেশের অন্য প্রান্তে। বাড়ি ফিরে রাতে সকলে ঘুমাচ্ছিলেন। ভোরের আলো ফোটার আগেই সব শেষ। অন্তত ৮০০০ বহুতল ভেঙে পড়েছে। এখানকার বহুতলগুলিতে একাধিক বাড়ি থাকে। কত মানুষ যে আটকে গিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। তুরস্ক সরকার বলছে, ১৪ হাজার মানুষ মারা গিয়েছেন। আমার মনে হয়, ওই সংখ্যা শেষমেশ আরও তিন গুণ হবে।
ভূমিকম্প হয়েছে কাহরামনমারাস, আদিয়ামানের দিকে। আমাদের শহর থেকে অনেকটাই দূর। তুরস্কের পশ্চিম দিকে ইস্তানবুল। আর ভূমিকম্প হয়েছে পূর্ব দিকে। কিন্তু গোটা দেশটা চুপ করে গিয়েছে। বাড়িতে স্ত্রী, ছেলে অর্জুন আর আমি। অর্জুনের স্কুল বন্ধ। আমিও অফিস যেতে পারছি না। ইচ্ছে করছে না। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় জামাকাপড়, কম্বল, খাবার পাঠাচ্ছি। যে ভাবে পারছি সাহায্য করার চেষ্টা করছি। আমি একা নই, সবাই করছে। ১০টা শহরে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সে সব জায়গায় সাহায্য পাঠানো হচ্ছে দেশের অন্যান্য শহর থেকে। কিছু পৌঁছচ্ছে। কিছু এখনও রাস্তায় আটকে।
ক্ষতিগ্রস্ত জায়গায় জামাকাপড়, কম্বল, খাবার পাঠাচ্ছি। যে ভাবে পারছি সাহায্য করার চেষ্টা করছি। ছবি: এএফপি।
সে দিন ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলার কথা জানার পর প্রথমেই মনে হয়েছে, জাতীয় দলে আমার সতীর্থরা সকলে ঠিক আছে তো! এক এক করে সকলকে ফোন করেছি। সকলের সঙ্গেই যোগাযোগ করতে পেরেছি। তবে আমার এক বন্ধু থাকে হাতায় নামে এক শহরে। ওর ফোন সেই থেকে বন্ধ। ওর পরিবারের অন্যদের ফোন করেও পাইনি। জানি না কী অবস্থায় আছে! ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি সর্ব ক্ষণ, একটা ভাল খবর যাতে আসে। জানি না শেষ পর্যন্ত কী শুনব!
আমি আদতে বাংলার উত্তর ২৪ পরগনার ছেলে। গোবরডাঙায় বাড়ি। তুরস্কের ভূমিকম্পের খবর জানতে পেরে ওখানকার সকলে চিন্তিত হয়ে পড়ে। একের পর এক ফোন এসেছে। বাড়ির। বন্ধুদের। আত্মীয়েরাও ফোন করেছেন। আমি সবাইকে একটাই কথা বলেছি, “বেঁচে আছি।” একের পর এক ফোন আর মেসেজের উত্তর দিতে দিতে একটা সময় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। বুঝতে পারছিলাম সকলে চিন্তা করছে। কিন্তু আমরা যারা এই ধ্বংস উপত্যকায় রয়েছি, তাদের আর ভাল লাগছে না।
আমার স্ত্রী এব্রু তুরস্কেরই মেয়ে। ওর সঙ্গে আমার পরিচয় বেঙ্গালুরুতে পড়াশোনা করার সময়। বিয়ের পর ২০১১-তে আমরা এ দেশে চলে আসি। এব্রু তো ছোটবেলা থেকেই ভূমিকম্পের সঙ্গে পরিচিত। আমি আসার পরেও বেশ কয়েক বার ভূমিকম্প হয়েছে। আমাদের কাছে সব সময় এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য একটা ‘কিট’ থাকে। তার মধ্যে বাঁশি, হেলমেট, কম্বল, ওষুধ, খাবার থাকে। কিন্তু ঘুমের মধ্যে বাড়ি ভেঙে পড়লে তো আর কিছুই করার থাকে না। সেটাই এ বার হয়েছে।
প্রতিটি শহরকে এক এক জন মন্ত্রীর দায়িত্বে দেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার। ছবি: এএফপি।
এখানে প্রচণ্ড ঠান্ডা। বরফ পড়ছে। তাই ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়াদের উদ্ধার করতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গিয়েছে। সরকারের পক্ষে ১০টি প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহরকে স্বাভাবিক করা খুবই কঠিন। প্রতিটি শহরের দায়িত্ব এক এক জন মন্ত্রীর কাঁধে দেওয়ার চেষ্টা করেছে সরকার। নাগরিকদের অনেকেই সরকারের দোষ দিচ্ছে। কিন্তু এমন অবস্থা সামলানোর জন্য কিছুটা সময় তো লাগবেই। ফোন পরিষেবা এখনও স্বাভাবিক হয়নি। কাউকে ফোন করলে তিনি দ্রুত কথা বলে রেখে দিচ্ছেন। কারণ মোবাইলে চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থাটুকুও করা সম্ভব হয়নি এখনও ওই শহরগুলিতে।
ভূমিকম্প তো আগেও হয়েছে। কিন্তু এ রকম একাধিক শহরকে একসঙ্গে ধ্বংস হয়ে যেতে দেখিনি কখনও। ভাল লাগছে না। কাজে যেতে ইচ্ছে করছে না। আমি এখানে যোগব্যায়ামের শিক্ষক। সঙ্গে ক্রিকেট খেলি। তুরস্কে তো ক্রিকেট সে ভাবে পরিচিত খেলা নয়। গোবরডাঙায় থাকার সময় টেনিস বলে ক্রিকেট খেলতাম। চামড়ার বলে প্রথম খেলি বেঙ্গালুরুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে। পরে এখানে এসে কয়েক জন পাকিস্তানি এবং আফগান যুবকের সঙ্গে আলাপ হয়। তার পর সকলে মিলে শুরু করি। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে খেলেছি এ বার। মূল পর্বে উঠতে পারিনি যদিও। কিন্তু এ সব এখন তুচ্ছ মনে হচ্ছে। বেঁচে থাকার কাছে এ সব সত্যিই বড় নগণ্য।
এখন শুধু ভাবছি, ইস্তানবুলে ভূমিকম্প হলে কী হত! টিভিতে দেখছিলাম, ধ্বংসস্তূপ থেকে একটা শিশুকে উদ্ধার করা হচ্ছে। শিউরে উঠেছি। অর্জুনের মুখটা মনে পড়ছিল। টিভিটা সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিয়েছি। বাড়িতে ওর সঙ্গেই রয়েছি। একটা ভয় মাথার মধ্যে চেপে বসে গিয়েছে। ভূমিকম্প আবারও হবে। হতেই থাকবে। যদি কখনও তুরস্কের পশ্চিম দিকে হয়! ইস্তানবুলেও যে হবে না, তার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই। এ বার বেঁচে গিয়েছি। কিন্তু পরের বার!
(শান্তনু ঘোষের নেওয়া সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত।)