এভারেস্টের শীর্ষে। ছবি: পিয়ালি বসাকের সৌজন্যে
তখন লোৎসের ক্যাম্প-২ থেকে নামছি বেসক্যাম্পের দিকে। আবহাওয়া কিছুটা খারাপ, জোরে হাওয়া চলছে। খুম্বু আইসফল এলাকা পর্যন্ত তখনও পৌঁছইনি। হঠাৎ দেখলাম, পায়ের নীচের ঝুরঝুরে বরফ সরে গিয়ে আমি নেমে যাচ্ছি নীচে, ক্রেভাসের (বড় ফাটল) মধ্যে! গত কয়েক দিনের খারাপ আবহাওয়া আর তুষারঝড়ে নতুন বরফ পড়ে ওই এলাকার ছোট ছোট ক্রেভাসগুলো ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। আর আমাদেরও ভুল হয়েছিল যে, পায়ের জুতোয় ক্র্যাম্পন লাগানো ছিল না। ‘রোপ আপ’ করাও ছিল না। আর সেই ভুলের চরম মাসুল দিতে যাচ্ছিলাম আমি। মুহূর্তে দেখলাম, ক্রেভাসের মধ্যে ঝুলছি! ক্রেভাসের সরু জায়গায় একটা পা আটকে যায় আমার। না হলে আমায় আর খুঁজে পাওয়া যেত না।
সে সময়ে ওই চত্বরে আমি আর দাওয়া শেরপাজি ছাড়া আর জনমনিষ্যি নেই। দাওয়া দাজুর পক্ষেও একা আমায় তোলা সম্ভব ছিল না। ওয়াকিটকির ব্যাটারির চার্জও শেষ, ফলে কাউকে খবর দেওয়ার জো নেই। শেষে দাজু ফের ছুটলেন ক্যাম্প-২ এর দিকে, সাহায্যের আশায়। সেখান থেকেই বিশিষ্ট পর্বতারোহী নির্মল পূরজার সঙ্গী মিংমা ডেভিড শেরপা ও আরও পাঁচ-ছ’জন এলেন আমায় উদ্ধার করতে। তত ক্ষণ ক্রেভাসের দেওয়াল আঁকড়ে কোনও মতে ঘণ্টাখানেক ঝুলে ছিলাম আমি!
বৃহস্পতিবারের এই একটি ঘটনাই নয়। গত কয়েক দিনের এমন নানা অভিজ্ঞতা আমার জীবন-দর্শনটাই বদলে দিয়েছে। কারণ, এই ক’দিনে শুধু দু’টি আটহাজারি শৃঙ্গেই উঠিনি, সাক্ষাৎ মৃত্যুমুখ থেকে বেঁচে
ফিরেছি। বার বার।
সোম-মঙ্গলবার নাগাদ এভারেস্টের আবহাওয়া খারাপ থাকবে, সেই পূর্বাভাস ছিলই। তাই উপায় না দেখে কিছুটা খারাপ আবহাওয়ার মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছিলাম গত শনিবার, এভারেস্ট সামিটের পথে। সঙ্গী দাওয়া দাজু। হিলারি স্টেপের কাছাকাছি যখন পৌঁছেছি, খারাপ আবহাওয়া ততক্ষণে তুষারঝড়ের রূপ নিয়েছে। হিলারি স্টেপের কাছে রক টাওয়ারগুলো এতটাই পিচ্ছিল যে, ক্র্যাম্পনও লাগছে না ঠিকমতো। এক বার ঝড়ের দাপটে ছিটকে পড়লাম একপাশে। দেখলাম, পড়ে থাকা কোনও এক পর্বতারোহীর মৃতদেহের উপরে গিয়ে পড়েছি!
অতিরিক্ত অক্সিজেনের সাহায্য ছাড়াই এভারেস্ট-লোৎসে করব— পণ করেছিলামই বলা যায়। কিন্তু ওই উচ্চতায়, অতটা খারাপ আবহাওয়ায় দাওয়া দাজুই সঙ্গে থাকা অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহারের পরামর্শ দিলেন। কারণ, অক্সিজেন না নিলে শরীরের তাপমাত্রা আরও কমে যেতে থাকবে, বিপদ আরও বাড়বে। এ দিকে তুষারঝড়ের ঠেলায় ঠান্ডা বেড়ে গিয়েছে মারাত্মক (প্রায় মাইনাস ৬০-৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। পথে যে একটু গ্লাভস খুলে ছবি-ভিডিয়ো তুলব, সে উপায়ও নেই।
তাই ওই উচ্চতায় পৌঁছেও শেষ পর্যন্ত অতিরিক্ত অক্সিজেন ব্যবহারের সিদ্ধান্তটা অত্যন্ত কঠিন ছিল। আগের বারের এভারেস্ট অভিযানেও (২০১৯ সাল) ব্যালকনি থেকেই ফিরতে হয়েছিল, সেই সঙ্গে এ বারের টাকাপয়সার জন্য এত লড়াই— তা-ও সব ঠিক চলছিল। খারাপ আবহাওয়াটাই হিসাব গোলমাল করে দিল। তবে বেঁচে ফেরাটাই আসল, তাই ওই সিদ্ধান্তটা নিতেই হত। বেসক্যাম্পে বসে এখন আর এর জন্য আফশোস নেই।
এর পরে যে কী ভাবে তুষারঝড়ের সঙ্গে লড়ে আমরা সামিটে পৌঁছেছি, তা শুধু আমরাই জানি। সকাল ১০টাতেও তখন চারদিক অন্ধকার, কয়েক হাত দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলবে, এমন অবস্থা। প্রকৃতির ওই রুদ্ররূপের মধ্যে সামিটে পৌঁছে মনে হচ্ছিল, বেঁচে ফিরব তো? মনে পড়ছিল বাবা-মার কথা। মনে হচ্ছিল, বেঁচে ফিরলে যেন আরও একটু ভাল মানুষ হয়ে উঠতে পারি। জীবনের মূল্য যে কতটা— সে দিন এভারেস্টের শীর্ষে কাটানো ওই ৫-৭ মিনিট বার বার আমায় তা মনে করিয়ে দিয়েছে।
বিপদ মাথায় করে, ভয়ঙ্কর তুষারঝড়ের মধ্যে সে দিন শুধু আমরাই সামিট করেছিলাম। বাকিরা সামিট পুশ শুরু করেও ফিরে যান। ফলে ফিরতি পথেও শুধুই আমরা দু’জন। এ দিকে তুষারঝড় ততক্ষণে ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে। চার দিকে ‘হোয়াইট আউট’। ঠান্ডা হাওয়া ঝাপট মারছে চোখে-মুখে। স্নো গগল্সের উপরে বরফের আস্তরণ জমে যাচ্ছে। ফলে এক সময়ে গগল্স খুলতেই হল। তখন প্রায় মরণ-বাঁচন পরিস্থিতি। দাওয়া দাজু ওয়াকিটকিতে যোগাযোগ করলেন নীচে, সামিটের খবর জানিয়ে বলেছিলেন, হয়তো বেঁচে ফিরব না।
এ দিকে তুষারঝড়ের ভয়ে সামিট ক্যাম্প থেকেও পর্বতারোহীরা নীচে নেমে গিয়েছেন। ফলে আমরা দু’জন পথ হারালে, অথবা কোনও বিপদ হলে সাহায্য আসারও আশা নেই। ঝড়ের দাপট এতটাই যে, ঢালু শৈলশিরার পথে ধাক্কা মেরে ফেলে দিচ্ছে। রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না। সাক্ষাৎ মৃত্যুমুখ থেকে সে দিন সন্ধ্যাবেলা দু’জনে সামিট ক্যাম্পে ফিরে এসেছিলাম।
রাতে খেয়েদেয়ে হঠাৎ দেখি, চোখে প্রবল যন্ত্রণা! জল পড়ছে নাগাড়ে। ফেরার পথে গগল্স খুলে ফেলায় ঠান্ডা লেগে ওই দশা। তাই শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকলেও চোখের কারণেই সে দিনটা আর লোৎসে যাওয়ার কথা ভাবতে পারিনি। পরের দিন নীচের ক্যাম্প থেকে উদ্ধারকারী শেরপারা এসেছিলেন বটে, তবে ততক্ষণে বিশ্রাম পেয়ে আমি অনেকটা চাঙ্গা। চোখের অবস্থাও ভাল। তাই বেশি দেরি করলে আবহাওয়া আরও বিগড়ে যাবে— সেই আশঙ্কায় সোমবার রাত ৯টা নাগাদই এগোলাম লোৎসের দিকে। সে রাতে বরং খারাপ আবহাওয়ার পূর্বাভাস থাকা সত্ত্বেও হাওয়া তেমন বেশি ছিল না। মঙ্গলবার সকালের লোৎসে সামিটটা তাই ছিল তুলনায় কম ভয়ঙ্কর। কম ঘটনাবহুলও।
এত কাণ্ডের পরে শেষ পর্যন্ত বেসক্যাম্পে অক্ষত পৌঁছেছি। অর্থের প্রতিবন্ধকতার কারণে আগে এভারেস্টের পারমিট পাইনি, না হলে হয়তো দুর্দান্ত আবহাওয়ায় ভালয় ভালয় সামিট করে ফেলতে পারতাম, তুষারঝড়ের মুখে পড়তে হত না। তবে এই অভিজ্ঞতা জীবনের অনেক বড় শিক্ষা দিয়ে গিয়েছে। এখনও কয়েক লক্ষ টাকা আয়োজক সংস্থাকে দেওয়া বাকি, জানি না তার আগে ওরা সামিট সার্টিফিকেটটা দেবে কি না। আজ, শনিবার বা রবিবার কাঠমান্ডু পৌঁছব।
তার পরে? হয়তো আবার আর একটা লড়াই।
অনুলিখন: স্বাতী মল্লিক
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।