প্রতিমা পাল
দিনটা কখনও ভুলবেন না প্রতিমা পাল। ক্লাস টু-এ পড়া মেয়েকে নিরক্ষরতা দূরীকরণ মিশনের ক্লাসে হাতে গোটা একটা চক ধরিয়ে দিয়েছেন বয়স্ক স্যর। বলেছিলেন, ‘‘তুই যা যা জানিস, লিখে লিখে পড়া দেখি!’’ সামনে পড়ুয়া হিসাবে বসে আছেন মা-বাবার বয়সি লোকজন। ছোট্ট প্রতিমা উঁচু বোর্ডে কোনও মতে লিখে লিখে পড়াচ্ছে অ-আ-ক-খ। সে দিন ক্লাস টু-এর মেয়ে দিদিমণি। কারণ, তার অক্ষরজ্ঞান হয়ে গিয়েছে, বাকিরা বয়সে অনেক বড় হলেও কখনও পড়াশোনা করেননি। তাই এ দিন তাঁরা সবাই প্রতিমার ছাত্রছাত্রী।
পড়াশোনার খিদেটা কোনও দিন যায়নি প্রতিমার। তাই সাঁইত্রিশ বছরে এসে রবীন্দ্র মুক্ত বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলেন। যে অঙ্কে আটকে গিয়েছিলেন ২০১৩ সালে, তাতে ৭২ নম্বর পেয়ে পাশ করলেন ২০২১ সালে।
প্রতিমা পাল তিন সন্তানের জননী। বিয়ের পর থেকে সংসার খরচ টানার জন্য কাজ করে যেতে হয়েছে স্বামীর পাশাপাশি। স্বামী রিকশা চালান, তা দিয়ে পাঁচ জনের পেট ভরে না। তাই লোকের বাড়ি রান্নার কাজ করেন প্রতিমা। দুই ছেলেমেয়ে বড়। তাদের স্কুলের পড়াশোনা, বাড়ির দেখভাল সামলে নিজের কোলের সাড়ে তিন বছরের সন্তানটিকেও মানুষ করছেন। তার পাশে পাটুলি রোকেয়া শিক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে চালিয়ে গিয়েছেন অঙ্কের অনুশীলন।
বাইরের-ঘরের কাজের পরে সময় পেতেন কী ভাবে? প্রতিমা বলেন, ‘‘গড়িয়ার গড়াগাছায় ভাড়া ঘরে থাকি। বস্তিতে যেমন ঘর হয়, তেমন ঘর। পড়াশোনার মতো পরিবেশ নেই। তবু যখনই সময় পাই, বই খুলে মুখ গুঁজি। কখনও রাত দুটোয় ঘুম ভেঙে গেলে পড়তে বসে যাই। বইয়ে মুখ গুঁজলেই আমার একটু শান্তি।’’
ক্লাস টু-এর পর দরিদ্র পরিবারের মেয়ে প্রতিমার আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। যখন তাঁর বছর দশ, বাবার এমন অসুখ হয় যে, কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকে মায়ের কাজের বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতে হাতে সাহায্য করতেন ছোট্ট প্রতিমা। তিনি বড় বোন, দায়িত্ব অনেক। গর্ব করে প্রতিমা বলেন, ‘‘আমার এক ভাই সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। যাদবপুর থেকে পড়াশোনা করে নিজে পায়ে দাঁড়িয়েছে। আলাদা ফ্ল্যাট কিনেছে। আর এক ভাই মাধ্যমিক অবধি পড়ে গাড়ি চালানোর ট্রেনিং সেন্টার খুলেছে। কাজ করে জমি কিনে ছোট বাড়ি করেছে নরেন্দ্রপুরে। সেখানে এখন মা-বাবা থাকেন।’’
কিন্তু তাঁর জীবন? ক্লাস টু-এর স্কুলছুট মেয়ে ফের কী ভাবে পড়াশোনায় ফিরলেন? প্রতিমার সপ্রতিভ জবাব, ‘‘আমি পড়াশোনার ইচ্ছে ছাড়িনি! বিয়ের আগে, পরে কিংবা বাচ্চা হয়ে গেলেও মাথায় ছিল মাধ্যমিক পাশ করতেই হবে।’’
জানালেন, যখন বছর চব্বিশ বয়স, প্রতিমা রান্নার কাজে আসতেন নরেন্দ্রপুর থেকে দাসপাড়া, সেই সময়ে এক দিন রাস্তায় বিকেলবেলা মেয়েদের স্কুলে যেতে দেখেন। কথা বলে খোঁজ পান নিবেদিতা নৈশ স্কুলের। বড় দিদিমণির সঙ্গে দেখা করে ভর্তি হন সপ্তম শ্রেণিতে। সেখান থেকেই একটি মুক্ত বিদ্যালয়ের মাধ্যমে প্রথম মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসা। প্রতিমা বলেন, ‘‘২০১৩ সালে অঙ্কে পাশ করতে না পেরে ২০১৪ সালে ফের অঙ্ক পরীক্ষা দিই। কিন্তু ফল আরও খারাপ হয়। তার পরে বাচ্চা হল। নিজের অসুখ, সংসারের নানা ঝামেলায় আটকে গেলাম। কিন্তু তলে তলে প্রস্তুতি চালিয়ে গিয়েছি। ভাইয়েরা কেউ জানত না। একেবারে ফর্ম ফিল-আপ করে জানিয়েছি।’’
এই বার পাটুলির রোকেয়া শিক্ষাকেন্দ্র থেকে প্রস্তুতি নিয়েছেন প্রতিমা। লকডাউনে চাল-ডাল বিলি করতে আসা দাদা-দিদিদের মাধ্যমে ওই অবৈতনিক শিক্ষাকেন্দ্রের খোঁজ পান। কথা ছিল ছেলেমেয়েকে পাঠাবেন। পরে তিন বাড়ির রান্নার কাজ সামলে নিজেও চলে আসতেন অঙ্ক শিখতে। যার ফল হাতেনাতে পেয়েছেন গত সপ্তাহে। রবীন্দ্র মুক্ত বিদ্যালয় থেকে অঙ্কে ৭২ পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছেন প্রতিমা পাল। বলেন, ‘‘ছেলে আমার রেজাল্টে খুব খুশি। সবাইকে আনন্দ করে বলে বেড়াচ্ছে। এখন এক জন সিক্স, আর এক জন এইটে পড়ে। খরচ বাড়ছে। কিন্তু ছেলেমেয়েদের যত দূর পারব, পড়াব।’’
রোকেয়া শিক্ষাকেন্দ্রে তাঁকে অঙ্ক করাতেন বছর পঁচিশের সুশোভন নায়েক। তিনি বলেন, ‘‘প্রতিমাদিকে পাটিগণিতের ক্ষেত্রে বাস্তব জীবনের উদাহরণ দিয়ে বোঝালে সহজে বুঝতেন। আমায় খুব বেশি খাটতে হয়নি। আর একটা জিনিস হল চেষ্টা। সেটা কখনও ছাড়েননি। সব কাজ সেরে ছেলেকে নিয়ে রাতে পড়তে বসতেন। ছোট ছেলের জ্বর, তাকে নিয়েও কোচিং-এ পড়তে এসেছেন।’’
এর পরের পরিকল্পনা কী প্রতিমার? প্রতিমা উচ্ছ্বসিত গলায় বলেন, ‘‘বয়েস অল্প হলে বলতাম, যে ভাবেই হোক চাকরির জন্য চেষ্টা করব। তবে এ বার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি নেব। কালই গিয়েছিলাম ফর্ম ভরতে, খুব লাইন ছিল বলে পারিনি। কিন্তু পরীক্ষা দেবই।’’