কলকাতা থেকে দিল্লি, আবার দিল্লি থেকে কলকাতা। দীর্ঘ দিনের টানাপড়েনের অবশেষে সমাপ্তি। পশ্চিমবঙ্গে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার লক্ষ্যে বারো বছর আগে তৈরি হওয়া সেই আইন এ বার দিনের আলো দেখতে চলেছে।
২০০৩-এ বাম আমলে রাজ্য বিধানসভায় সংশ্লিষ্ট বিলটি প্রথম পেশ হয়েছিল, যা কিনা ২০১৩-য় তৃণমূল সরকার নতুন করে পাশ করায়। তার মধ্যে সেটি বেশ কয়েক বার দিল্লি থেকে ফেরত এসেছে, সংশোধনী জুড়ে আবার দিল্লি গিয়েছে। শেষমেশ ক’দিন আগে, ২০১৫-র মাঝ-এপ্রিলে তাতে মিলেছে রাষ্ট্রপতির সম্মতি।
তবে সম্মতির একটা শর্তও আছে। কেন্দ্রকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মতো ছ’মাসের মধ্যে রাজ্য সরকার বিলটিতে আর একটি সংশোধনী জুড়বে, এই শর্তেই রাষ্ট্রপতি সই করেছেন বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। রাজ্যপাল ইতিমধ্যে এ কথা নবান্নকে জানিয়েও দিয়েছেন। রাজ্য প্রশাসন সূত্রের খবর: নিয়ম-কানুন মেনে কিছু দিনের মধ্যে বিলটিকে আইনে পরিণত করে সরকারি বি়জ্ঞপ্তি জারি হবে। ‘‘কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের চিঠি রাজভবন হয়ে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। বিলটিকে আইনে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।’’— বলেছেন নবান্নের এক শীর্ষ কর্তা।
কিন্তু ঘটনা হল, সারদা-রোজ ভ্যালির মতো যে সব আর্থিক কেলেঙ্কারির প্রেক্ষাপটে নতুন করে ওই আইন প্রণয়নের তোড়জোড় শুরু হয়েছিল, সেগুলির ক্ষেত্রে এর ব্যবহার সম্ভব হবে না। কারণ, আইনটি কার্যকর হবে সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারির সময় থেকে, যার বহু আগেই ঘটে গিয়েছে সারদা বা রোজ ভ্যালি-কাণ্ড।
বিলে রাষ্ট্রপতির সম্মতি পেতে এত বছর লাগল কেন?
অর্থ দফতরের ব্যাখ্যা: লগ্নিসংস্থায় টাকা রেখে প্রতারিতদের স্বার্থরক্ষায় ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রোটেকশন অব ইন্টারেস্ট অব ডিপোজিটর্স ইন ফিনান্সিয়াল এস্টাব্লিশমেন্ট’ শীর্ষক বিলটি ২০০৩-এ বিধানসভায় পাশ হওয়ার পরে তার আইনি অবস্থান সম্পর্কে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক একগুচ্ছ প্রশ্ন তুলেছিল। সে সব পাশ কাটিয়ে ২০০৮-এ রাজ্যের তদানীন্তন বাম অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত আবার একটি বিল পেশ করেন। পুরনো বিলটি তখনও রাষ্ট্রপতির অফিসেই পড়ে রয়েছে। এমতাবস্থায় তৎকালীন বিরোধী দল তৃণমূল প্রশ্ন তোলে, একই বিষয়ে আর একটা বিল আনার যৌক্তিকতা কী?
এ নিয়ে বিতণ্ডা চলতে চলতেই তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল পুরনো বিলটি ফেরত পাঠিয়ে দেন। এবং ২০০৮-এ বিধানসভায় পাশ হওয়া বিলটি রাজ্য সরকার ২০০৯-এ দিল্লি পাঠায়, রাষ্ট্রপতির অনুমোদন চেয়ে। তার পরে বছর চারেক ধরে রাজ্য বারবার তাগাদা দিলেও বিলে রাষ্ট্রপতির সম্মতি মেলেনি।
ব্যাপারটা যখন প্রায় ঠান্ডা ঘরে চলে যাওয়ার জোগাড়, তখন আচমকা পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ২০১৩-য় ফাঁস হয় সারদা কেলেঙ্কারি। শোরগোল ওঠে, ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার অবৈধ কারবার ঠেকানোর যোগ্য আইন কেন রাজ্যের হাতে নেই! সরকারি মহলে তৎপরতা শুরু হয়। আর ঠিক তখনই কেন্দ্রও হঠাৎ ২০০৯-এর বিলটি ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
এই পরিস্থিতিতে ২০১৩-র ৩০ এপ্রিল বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডেকে বাম জমানার বিলটি প্রত্যাহার করে নতুন বিল পেশ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র স্বয়ং নয়াদিল্লি বিমানবন্দরে গিয়ে বিদেশ প্রত্যাগত তৎকালীন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের অনুমোদন নিয়ে মে মাসের গোড়ায় বিলটি পাঠিয়ে দেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে, যেখান থেকে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রকের মতামত সমেত তা রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ হওয়ার কথা।
মতামত গ্রহণের পর্বেই ঠোক্কর খেতে হয়। নবান্নের খবর, কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক পরের মাসে কয়েকটি বিষয়ে রাজ্যের ব্যাখ্যা চেয়ে পাঠায়। কী রকম?
মন্ত্রকের প্রশ্ন ছিল: এই ধরনের অপরাধের বিচারের জন্য বিলে বিশেষ আদালত গঠনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেই আদালতের বিচারপতিকে সংশ্লিষ্ট লগ্নিসংস্থার যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার দেওয়া নেই কেন? প্রয়োজনে ভিন রাজ্যের অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধেও ওই আদালতে মামলা করার সংস্থান আইনে রাখা দরকার বলে মতামত দিয়ে উদাহরণ হিসেবে তামিলনাড়ুর উল্লেখ করেছিল দিল্লি। জোর দেওয়া হয়েছিল, প্রস্তাবিত আইনে কোনও ভাবেই যাতে অভিযুক্তদের আগাম জামিনের সুযোগ না-থাকে। এ প্রসঙ্গে বিহার-মধ্যপ্রদেশের সংশ্লিষ্ট আইনের দৃষ্টান্তও দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে বলা হয় কম্পাউন্ডিং অব অফেন্সেস-এর বিষয়টিও জুড়তে। যার অর্থ, আদালতের সম্মতিসাপেক্ষে অভিযুক্তেরা মোটা অঙ্কের জরিমানা দিয়ে কারাবাস থেকে রেহাই পেতে পারবেন।
অর্থ মন্ত্রকের এই সব প্রস্তাবে যে পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি নেই, ২০১৩-র ৭ জুন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই তা জানান। এ-ও বলেন, ‘‘আমরা কেন্দ্রকে জানিয়ে দিচ্ছি, তাদের প্রস্তাব আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পাওয়ার পরে আমরা তা করে নেব।”
নবান্নের খবর, রাজ্যের মনোভাব কেন্দ্রকে জানানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে, ২০১৩-র ১০ জুন অর্থ মন্ত্রকের রাজস্ব ও আর্থিক পরিষেবা সংক্রান্ত বিভাগ আরও ব্যাখ্যা চায়। তারা প্রশ্ন তোলে, অর্থলগ্নি সংস্থা প্রতারণা করলে বা আমানতকারীদের টাকা ঠিকঠাক ফেরত না-দিলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বিলে থাকলেও বাজারে নামার সময় থেকে সংস্থাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে কী ভাবে? দিল্লি মনে করে, আগাম সতর্কতা হিসেবে এই ধরনের সংস্থার টাকা তোলার কারবার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও রাজ্যের আইনে থাকা দরকার। পাশাপাশি দেখতে হবে, সংস্থাগুলি কারবার শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে যেন রাজ্য সরকারকে সে ব্যাপারে অবহিত করতে বাধ্য থাকে। ঠিক সময়ে ঠিক তথ্য না-দিলে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের ধারাও নতুন আইনে রাখা দরকার বলে দিল্লি জানিয়ে দেয়।
দফায় দফায় আলোচনা চলে। চারটি সংশোধনী সম্পর্কে কেন্দ্র-রাজ্য সহমত হয়। সেই মতো ২০১৩-র সেপ্টেম্বরে রাজ্যকে বিল ফেরত পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। সংশোধনী জুড়ে তা ফের দিল্লি পাঠানো হয়। তাতেও নিষ্পত্তি হয়নি। দিল্লি আরও কিছু প্রশ্ন তোলে। শেষমেশ মমতা সরকার ২০১৪-র এপ্রিলে ফের বিশেষ অধিবেশন ডেকে আরও কিছু সংশোধনী তাতে যুক্ত করে। তার পরে আবার তা দিল্লিতে পাঠানো হয়।
এবং দিন পনেরো আগে রাষ্ট্রপতি সেই বিলেই সম্মতি দিয়েছেন।
এখন রাজ্যের দায়িত্ব তা আইনে পরিণত করা।