আড়চোখে কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়েরিটা কোনও ভাবে পড়ে ফেলেছেন নরেন্দ্র মোদী!
কারণ, কলকাতা হোক বা দিল্লি— প্রশাসনিক স্তরে অসহিষ্ণুতার কী অদ্ভুত সামঞ্জস্য। মিল প্রশাসকের অপারেশনেও।
আমলা থেকে সরকারি ডাক্তার। কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। মতের মিল না হলেই ছুটিতে পাঠিয়ে দাও। বদলি করে দাও কম গুরুত্বপূর্ণ পদে। তাতেও কাজ না হলে এমন হেনস্থা করো, যাতে তিনি নিজেই সরে যান। তা তিনি কোনও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হলেও একই দাওয়াই। কলকাতায় যদি সর্বশেষ নিদর্শন সদ্য-প্রাক্তন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় হন, তো রাজধানীর উদাহরণ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দীনেশ সিংহ।
রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ইজরায়েল সফরের জন্য ব্যাগও গুছিয়ে ফেলেছিলেন দীনেশ। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ছাত্র-বিনিময় থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে সহযোগিতা নিয়ে চুক্তি সারার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু সফরের মুখেই তাঁকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে (কম্পালসারি ওয়েটিং) পাঠানোর জন্য রাষ্ট্রপতিকে সুপারিশ করে বসেন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি।
আগামী ২৮ অক্টোবর উপাচার্য পদে দীনেশের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। স্মৃতির মন্ত্রকের অভিযোগ, পরবর্তী উপাচার্য বাছাই করবে যে সার্চ কমিটি, দীনেশ সেখানে হেরফের করে আখেরে নিজের মেয়াদই আরও কিছু দিন বাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ভিজিটর হিসেবে তাই রাষ্ট্রপতির কাছেই দীনেশকে কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে পাঠানোর আর্জি জানানো হয়। কিন্তু রাষ্ট্রপতির সচিবালয় জানায়, দীনেশের মেয়াদ আর মাত্র ক’দিন বাকি। তাঁকে আর ছুটিতে পাঠানো অনর্থক। ফলে পদে বহাল থেকে যান উপাচার্য। কিন্তু বিড়ম্বনা এড়াতে পারেননি। বিদেশ সফরও বাতিল হয়েছে তাঁর।
এই ঘটনাতেও পশ্চিমবঙ্গের ছায়া দেখছেন অনেকে। কারণ, শাসক দলের ছাত্র নেতাদের হাতে শিক্ষকদের হেনস্থা এবং স্বশাসিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি হস্তক্ষেপ ইদানীং প্রায় রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে মমতার রাজ্যে। এই সে দিনও কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ফি না কমালে তিনি নাকি উপাচার্যকে ‘রাখবেন না’!
মোদ্দা কথা, শাসক শিবিরের সুরে সুর না মিললেই হেনস্থা বাঁধা। গত চার বছরে এমন অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। সরকারের গোড়ার দিকে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য খণ্ডন করেছিলেন তৎকালীন গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী সেন। পত্রপাঠ বদলি। মুখ্যমন্ত্রীর আচমকা হাসপাতাল পরিদর্শন ঘিরে হুড়োহুড়িতে রোগীদের অসুবিধের কথা তাঁর সামনেই বলে ফেলেছিলেন বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজির অধিকর্তা শ্যামপদ গড়াই। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সাসপেন্ড হন তিনি।
পুলিশ কমিশনার রঞ্জিৎকুমার পচনন্দা যত দিন মাথা নত করে ছিলেন, ঠিক ছিলেন। কিন্তু গার্ডেনরিচে এক সাব-ইনস্পেক্টর খুন হওয়ার পর বাহিনীর পাশে থাকতে গিয়ে নবান্নের বিরুদ্ধাচরণ করে বসেন। মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ক্লিনচিট দেওয়া সত্ত্বেও মূল অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা মুন্নাকে গ্রেফতার করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন সিপি। দ্রুত পচনন্দাকে পাঠানো হয় কম্পালসারি ওয়েটিং-এ। দু’বছর আগে নভেম্বরে শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন পর্ষদ (এসজেডিএ)-এ বহু কোটি টাকার দুর্নীতি মামলায় মালদহের তৎকালীন জেলাশাসক গোদালা কিরণকুমারকে গ্রেফতার করেন শিলিগুড়ির তৎকালীন পুলিশ কমিশনার কে জয়রামন। সরকারকে ‘উপেক্ষা করে’ ওই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অপরাধে একই সাজা হয় জয়রামনের। কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে যান তিনিও।
প্রশাসনের অন্যত্রও ছবিটাও আলাদা নয়। নবান্নের অন্দরের খবরই বলে, শাসক শিবিরের মন জুগিয়ে চলতে না পারায় কার্যত গুরুত্বহীন দায়িত্ব সামলাতে হয় নন্দিনী চক্রবর্তী, সুবেশ দাসের মতো আমলাদের। আর মুখ্যমন্ত্রীর আস্থাভাজন আমলাকে আইনের ফাঁক গলে বসিয়ে দেওয়া হয় রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পদে।
মসনদে পাঁচ বছর পূর্ণ করতে চলা মমতার রাজ্যপাটের এই রোগের ছোঁয়াচই যেন মোদীর ‘নবীন’ সরকারে। সেখানে মাত্র দেড় বছরেই বহু শীর্ষ পদে রদবদল ঘটেছে। শোনা যায়, স্রেফ শাসক শিবিরের অপছন্দের কারণেই পদ খুইয়েছেন একাধিক সিনিয়র আইএএস-আইপিএস। মাত্র ৮ মাসের মধ্যে তিন জন স্বরাষ্ট্রসচিবকে দেখেছে দিল্লি। শাসক শিবিরের সব নির্দেশ চোখ বুজে মানতে চাননি সদ্য অপসারিত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব এল সি গয়াল। মেয়াদ শেষের আগেই সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। দায়িত্বে আসেন মোদী-ঘনিষ্ঠ রাজীব মহর্ষি।
এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর ডিজি রঞ্জন কাটোচ এবং স্পেশ্যাল প্রোটেকশন গ্রুপ (এসপিজি)-এর প্রধান দুর্গা প্রসাদ— মোদী জমানায় ‘প্রাক্তন’ হয়ে যান দু’জনেই। শাসকের বিরাগভাজন হওয়াতেই তাঁদের সরে যেতে হয় কম গুরুত্বপূর্ণ পদে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজন ও অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ এই সে দিনও চরমে পৌঁছেছিল। অভিযোগ উঠেছিল, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চাইছে কেন্দ্র।
স্মৃতি ইরানির যদিও গোড়া থেকেই সঙ্গী বিতর্ক। শোনা যায়, তাঁকে এড়াতেই অন্য মন্ত্রকে বদলি নিয়ে চলে গিয়েছেন একাধিক আমলা। ক্ষমতায় আসা ইস্তক শিক্ষাক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠছে স্মৃতির বিরুদ্ধে। এ-ও অভিযোগ, তাঁর অবস্থান মানতে চাননি বলেই সরতে হয়েছে আইআইটি-সহ একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দীনেশকে নিয়ে যদিও শুরু থেকেই আপত্তি ছিল সঙ্ঘ পরিবারের। স্নাতক স্তরে চার বছরের পাঠ্যক্রম চালু করার সময়েই তাঁর সঙ্গে বিরোধ বেধেছিল স্মৃতির। কিন্তু এ বার তা চরমে পৌঁছল।
‘দিদি’র রাজ্য হোক বা মোদীর— কেন এমন মনোভাব? সরকারি কর্তারা খুব একটা মুখ খুলতে চাইলেন না। চাকরি বড় বালাই! তবে একান্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক আমলা বললেন, ‘‘ক্ষমতার অলিন্দে থাকার জন্য এক ধরনের আমিত্বে ভোগেন নেতারা। ভাবেন, যা করছেন, সেটাই সত্যি। কিন্তু বাস্তবটা যে তা নয়, সেটা বোঝেন না।’’