নবান্নের করিডরে হাঁটছেন শাসক দলের প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি। আচমকা বাজল মোবাইল। ও পারে কলকাতা পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর শম্ভুনাথ কাও। সৌজন্য বিনিময়ের পরে শম্ভুনাথ এলাকার একটি সমস্যা মেটাতে অনুরোধ করেন ওই জনপ্রতিনিধিকে। দু’পক্ষে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়। ফোন রাখার পরে জনপ্রতিনিধির খেয়াল হয়, কাও তো জেলবন্দি! সেখান থেকে কী করে মোবাইল ব্যবহার করছেন তিনি?
ঘটনাটা চলতি মাসের গোড়ার দিকের এক বিকেলের। জানাজানি হতেই হইচই হয় নবান্নে। রাতে কারামন্ত্রী হায়দর আজিজ সফি জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই আলিপুর সংশোধনাগারে তল্লাশি চালানো হয়। উদ্ধার হয় চারটি মোবাইল ও একাধিক সিম-কার্ড। কারা দফতর সূত্রের দাবি, প্রাথমিক তদন্তে ওই তৃণমূল কাউন্সিলর নাকি তাদের জানান, জেলের অফিসার-কর্মীদের একাংশের ‘সহযোগিতা’য় মোবাইল মিলেছিল।
সংশোধনাগারের ভিতরে থেকে বন্দিদের মোবাইল ব্যবহার অবশ্য নতুন কিছু নয়। গত জুন মাসেই বহরমপুর সংশোধনাগার থেকে ৪০, প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগার থেকে ১৫, দমদম সংশোধনাগার থেকে ১৪, হুগলি ও মেদিনীপুর সংশোধনাগার থেকে সাতটি করে ও বর্ধমান সংশোধনাগার থেকে একটি মোবাইল উদ্ধার হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত শুধু কলকাতার তিনটি সংশোধনাগার (প্রেসিডেন্সি, আলিপুর ও দমদম) থেকে অন্তত ৩৫০টি মোবাইল বাজেয়াপ্ত হয়েছে। সিম-কার্ডের সংখ্যা তার দ্বিগুণ। হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর, বহরমপুর, জলপাইগুড়ি সংশোধনাগার থেকে উদ্ধার হয়েছে শতাধিক মোবাইল ও প্রায় সমসংখ্যক সিম-কার্ড।
তা বলে জেলে বসে কোনও বন্দি মোবাইলে শাসক দলের বিধায়ক কিংবা মন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথাবার্তা বলছেন, অতীতে এমন ঘটেনি। অন্তত, স্বরাষ্ট্র দফতরের নথি তাই-ই বলছে। ফলে, সন্দেহভাজন অফিসার-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু করেন জেল কর্তৃপক্ষ। আলিপুর জেলের সুপারকে সতর্ক করে স্বরাষ্ট্র দফতর। ওই পর্যন্তই।
কারা দফতর সূত্রেই জানা গিয়েছে, ঘটনার দিন কাওয়ের থাকার জায়গা থেকেই একটি মোবাইল মিললেও সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষ সব ক’টি মোবাইলকেই প্রাথমিক ভাবে ‘বেওয়ারিশ’ বলে নথিভুক্ত করেন। কয়েক মাস আগে রাজ্যের এডিজি (কারা) অধীর শর্মা এক নির্দেশে যে কোনও সংশোধনাগারে মোবাইল উদ্ধার হলে ধারেকাছের থানায় এফআইআর করার নির্দেশ দিয়েছেন। ওই নির্দেশে বলা হয়েছে, যে বন্দি ওই মোবাইল ব্যবহার করছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধেই এফআইআর করতে হবে জেল সুপারকে। উদ্ধার হওয়া মোবাইলের কল-রেকর্ড জোগাড়ের জন্য পুলিশের সাহায্য নেওয়ার কথাও ওই নির্দেশে বলা হয়। কিন্তু কাও-কাণ্ডের পরে জেল কর্তৃপক্ষ এখনও পর্যন্ত এফআইআর করেননি।
নির্দেশ অমান্য করা হল কেন? এডিজি (কারা) বলেন, “জেল সুপারের কাছে বিশদ রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। তা হাতে পেলেই পদক্ষেপ করা হবে।” কারামন্ত্রীর আশ্বাস, “বিভাগীয় তদন্তও শুরু হয়েছে। ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ঘটনাচক্রে, কাও-কাণ্ডের ক’দিন পরেই, জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহের গোড়ায় কলকাতার প্রেসিডেন্সি, দমদম ও আলিপুর এবং মেদিনীপুর সংশোধনাগারে বন্দিদের মধ্যে মোবাইলের যথেচ্ছ ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে কারা দফতরের কাছে রিপোর্ট চান খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, মেদিনীপুর-সহ বিভিন্ন সংশোধনাগারে বন্দি মাওবাদী নেতাদের একাংশ মোবাইল ব্যবহার করছেন বলেও খবর পেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মোবাইলের সুবাদে মাওবাদীরা জেলে বসেই নানা এলাকায় ফের অশান্তির ছক কষছে বলেও আশঙ্কা করছে রাজ্য সরকার।
এই পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্র দফতরের একাধিক কর্তা ঘনিষ্ঠ মহলে মেনেছেন, কাও-কাণ্ডের পরে প্রশাসনিক পদক্ষেপ ‘সন্তোষজনক’ হয়নি। ঘটনায় অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে কারা দফতরের অফিসার-কর্মীদের একাংশ কিছুটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন বলেও আশঙ্কা ওই কর্তাদের। তাঁরা বলছেন, “কারা দফতরকে দেওয়া চিঠিতে যে ভাবেই হোক জেলে বন্দিদের মোবাইলের ব্যবহার রোখার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বন্দিদের হাতে মোবাইল পৌঁছনো রুখতে কী পদক্ষেপ করা হয়েছে ও আগামী দিনে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা-ও জানতে চেয়েছেন। এখন তো শিরে সংক্রান্তি।”
প্রশাসন সূত্রের দাবি, চাপে পড়ে আসরে নেমেছে স্বরাষ্ট্র দফতর। রাজ্যের ৫৮টি সংশোধনাগারে মোবাইলের খোঁজে নিয়মিত তল্লাশি শুরু হয়েছে। তাতে ফের কিছু মোবাইল এবং সিম-কার্ড মিলেছে।
এখন প্রশ্ন হল, এই মোবাইল এবং সিম-কার্ড সংশোধনাগারে ঢুকছে কোন পথে?
(চলবে)