শিল্পা অগ্রবাল।
মেয়ে নিখোঁজ থাকার পর থেকেই উদ্বেগে ছিলেন শিল্পা ওরফে রূপা অগ্রবালের মা। তবুও মনের কোণে সাহস জমিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু ছ’দিন পরে যখন মেয়ের মৃত্যু সংবাদ পৌঁছল মেজিয়ার বাগানগড়ার বাড়িতে, তখন একেবারে ভেঙে পড়লেন তিনি।
বাগানগড়ায় ইটের গাঁথুনির ঘরে দারিদ্রের মধ্যে কোনওরকমে মা ও পোলিও আক্রান্ত দাদাকে নিয়ে দিনযাপন করছিলেন বড় মেয়ে শিল্পা। বছর দুয়েক তাঁর বাবা সত্যনারায়ণ অগ্রবালের মৃত্যুর পরে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। ছোট বোন সীমার আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির কাছেই ছিল তাঁর বাবার চালের ছোট্ট দোকান। সেই দোকান বন্ধ করতে দেননি শিল্পা। নিজেই দোকানে বসা শুরু করেন। দাদাকেও দোকানে টেনে নিয়ে গিয়ে কাজ শেখাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে বাড়ির কাছেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে কয়েক বছর আগে ব্যাঙ্ক মিত্রের কাজ পেয়ে যান তিনি।
পড়শিরা জানাচ্ছেন, শিল্পার গ্রাহকের সংখ্যাও কম ছিল না। চালের দোকানই ক্রমশ তার অফিস ঘর হয়ে উঠেছিল। দাদাকে স্বনির্ভর করে দিয়েই বিয়ে করবেন বলতেন শিল্পা। কিন্তু দাদাকে স্বাবলম্বী করার আগেই রহস্য-মৃত্যু হল বছর আটাশের এই যুবতীর। দুর্গাপুর থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে বোনের দেহ নিয়ে আসার পর থেকেই দাদা সন্দীপ অগ্রবাল অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অ্যাম্বুল্যান্সের জানলার ফাঁক থেকে মেয়ের মুখ দেখার পরেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন মা ঊষা অগ্রবাল। বোন সীমাও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হয়।
খুড়তুতো দাদা নন্দন অগ্রবাল বলেন, ‘‘শুক্রবার শিল্পা তার মাসির বাড়ি যাচ্ছি বলে বেরিয়ে আর ফেরেনি। তারপর থেকে সে কোথায় ছিল জানি না। তবে শনিবার সন্ধ্যায় শিল্পা তার দাদাকে ফোনে জানিয়েছিল, সে বাড়ি ফিরছে। কিন্তু সে ফেরেনি। এরপর থেকেই তার ফোন স্যুইচ অফ ছিল।’’ পুলিশ জানায়, রবিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করে তাঁরা মঙ্গলবার থানায় নিখোঁজের ডায়েরি করেন।
তারপর থেকে উদ্বেগে দিন কাটে তাঁদের। বুধবার কাঁকসা থানা থেকে খবর আসে এক যুবতীর দেহ উদ্ধার হয়েছে। সেখানে ছুটে যান শিল্পার পরিজনেরা। কিন্তু দেহটি তাঁর নয়। এ দিন সকালে দুর্গাপুর থেকে ফের ফোন আসে, একটি বহুতলে ব্যাগবন্দি দেহ উদ্ধার হয়েছে। সেখানে গিয়ে দেহ দেখেই শিল্পার দাদা সন্দীপ তা বোনের বলে চিনতে পারেন।
ব্যাগবন্দি শিল্পা
ঘটনাক্রম
•
শুক্রবার দুপুরে বাড়ি থেকে বেরোন শিল্পা অগ্রবাল।
•
আসানসোলে মাসির বাড়িতে যান। ছিলেন এক ঘণ্টা।
•
শনিবার সন্ধ্যায় শিল্পার সঙ্গে ফোনে শেষ কথা হয় দাদার। জানিয়েছিলেন, বাড়ি ফিরছেন।
•
ফেরেননি। মোবাইল বন্ধ।
•
মঙ্গলবার মেজিয়া থানায় নিখোঁজের ডায়েরি।
•
বুধবার কাঁকসায় তরুণীর দেহ উদ্ধারের খবর পেয়ে শিল্পার পরিজনেরা যান। শিল্পা নয়।
•
বৃহস্পতিবার সকালে ফোন আসে। দুর্গাপুরের বহুতলে দেহ মিলেছে। শনাক্ত করে পরিবার।
•
সকালেই বহুতলের ভাড়াটে রাজীব কুমার ও তাঁর স্ত্রী মনীষাকে আটক করে পুলিশ। দুপুরে গ্রেফতার করা হয়।
• দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালে দেহের ময়না-তদন্ত হয়।
• বিকেলে বাড়ি ফেরে দেহ।
এক বছর আগে বাঁকুড়ার আর এক যুবতী আকাঙ্ক্ষা শর্মার সিমেন্টের মমি হয়ে যাওয়া দেহ মিলেছিল প্রেমিকের বাড়ির ট্রাঙ্কে। ভোপালের সাকেতনগরের সেই ঘটনাও নাড়িয়ে দিয়েছিল অনেককে। তারপরে জেলারই আর এক মেয়ে শিল্পার এই পরিণতি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে শিল্পার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, উঠোনে তাঁর মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছিলেন। সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন ছোট মেয়ে সীমা ও আত্মীয়েরা। মাঝে মধ্যেই কাঁদতে কাঁদতে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলছিলেন তিনি। বাইরে ছিল পড়শিদের জটলা। সেখানেই জানা যায়, শুক্রবার দুপুরে আসানসোলে মাসির বাড়িতে তিনি গিয়েছিলেন। সেখানে এক ঘণ্টা কাটিয়েই তিনি বেরিয়ে যান। তারপর থেকে আর বাড়ি ফেরেননি।
দুর্গাপুরে দেহ আনতে আসা শিল্পার পড়শি শঙ্কু চন্দ্র বলেন, ‘‘আমাদের সন্দেহ হওয়ায় বুধবার ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি অস্বীকার করেন। তবে কথা বলার সময় তাঁকে আত্মবিশ্বাসী মনে হয়নি। তিনি কাঁপছিলেন। হাত কচলাচ্ছিলেন। তাঁর মোবাইলের কললিস্টও মুছে ফেলা হয়েছিল বলে দেখেছি। এখন সব পরিষ্কার হয়ে গেল।’’
ভিড়: গাড়ির ভিতরে নিথর দেহ। বাইরে উৎসুক পড়শিরা। বৃহস্পতিবার। ছবি: অভিজিৎ সিংহ
শিল্পার এক খুড়তুতো দাদা অরূপ অগ্রবাল থাকেন রানিগঞ্জে। তিনি জানান, আগামী বৃহস্পতিবার শিল্পাদের নিয়ে তাঁদের সবার রাজস্থানের খাটুতে পুজো দিতে যাওয়ার কথা ছিল। তিনি বলেন, ‘‘খাটু যাওয়ার প্রসঙ্গেই কথা বলতে শনিবার দুপুরে আমি শিল্পাকে ফোন করেছিলাম। সে জানিয়েছিল, যাওয়ার প্রস্তুতি সব পাকা। কিন্তু কোথায় সে রয়েছে, বা কোনও সমস্যায় পড়েছে কি না, কিছুই জানায়নি। তার কথাবার্তাও ছিল স্বাভাবিক। পরে তার নিখোঁজ হওয়ার খবর শুনে অবাক হয়ে যাই।’’
সেই খবর মেজিয়ার বাড়িতে পৌঁছতেই শোকের ছায়া নেমে আসে। ঘটনার প্রতিবাদে আজ, শুক্রবার মেজিয়ায় বাজান বন্ধের ডাক দিয়েছে স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতি।
বাড়ি থেকেই ৫০ মিটার দূরে সেই ব্যাঙ্ক। সেখানকার ব্যাঙ্ক মিত্র ছিলেন শিল্পা। গোলমালের আশঙ্কায় এ দিন সেখানে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ব্যাঙ্কের ভিতরে কাজকর্ম চললেও পরিবেশ ছিল থমথমে। ম্যানেজারের সম্পর্কে কিছু জানতে চাওয়া হলেই কর্মীরা মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছিলেন।
তবে ব্যাঙ্কের গ্রাহকেরা জানিয়েছেন, মাস ছয়েক আগে রাজীব কুমার ম্যানেজার হয়ে মেজিয়ায় আসেন। তিনি গ্রাহকদের সঙ্গে তেমন কথা বলতেন না। ব্যাঙ্ককর্মীদের সঙ্গেও মেলামেশা করতে তাঁকে বিশেষ দেখা যেত না। বুধবার পর্যন্ত তিনি ব্যাঙ্কে এসেছেন। তবে গত ক’দিন ধরেই বেশ কিছুটা দেরিতে ব্যাঙ্কে আসছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাঙ্কের এক কর্মী আড়ালে ডেকে বলেন, ‘‘ম্যানেজারের ওই ঘটনায় নাম জড়িয়ে যাওয়ায় আমরা অবাক হয়ে গিয়েছি। তবে এখন ব্যাঙ্কের উঁচুতলার কর্তারা এসেছেন। কোনও কথা বলা যাবে না।’’
দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ দুর্গাপুর থেকে শিল্পার দেহ নিয়ে আসা হয় মেজিয়ায়। পাড়ায় অ্যাম্বুল্যান্স ঢুকতেই লোকজন সেখানে ছুটে যান। গাড়ি থেকে শিল্পার দাদা টলমল অবস্থায় নামতেই পড়শিদের কয়েকজন তাঁকে ধরে বাড়িতে নিয়ে যান। মা ঊষাদেবী বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। গাড়ির জানলার ফাঁক দিয়ে মেয়ের মুখ দেখেই কেঁদে বলে ওঠেন— ‘‘এ আমার মেয়ে রূপা নয়। আমি বিশ্বাস করি না। রূপা মরতে পারে না। সে বেঁচে রয়েছে।’’