ফল ঘোষণার আগে গণনাকেন্দ্রে মানস ভুঁইয়া ও সন্তোষ রাণা। নিজস্ব চিত্র।
তারকাদের রাজনীতির ময়দানে নামিয়ে ভোটে বাজিমাত করার কৌশল নিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোটের ফল বলছে, তিনি একশো শতাংশ সফল।
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিম মেদিনীপুরের তিনটি আসনে সহজ জয় পেয়েছিল বামেরা। এ বার জেলার তিনটি আসনের মধ্যে দু’টি আসনে তারকা প্রার্থী ছিল তৃণমূলের। মেদিনীপুরে অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়। ঘাটালে নায়ক দীপক অধিকারী ওরফে দেব। দু’জনই রাজনীতিতে আনকোরা। এই দুই তারকা প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন পোড়খাওয়া রাজনীতিক মানস ভুঁইয়া, প্রবোধ পণ্ডা, সন্তোষ রাণারা। মানসবাবু কংগ্রেসের পুরনো বিধায়ক। এক সময় প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্বও সামলেছেন। প্রবোধবাবু সিপিআইয়ের তিনবারের সাংসদ। আর সন্তোষবাবু সিপিআইয়ের জেলা সম্পাদক। এক সময় বিধায়কও ছিলেন। অথচ ফল বেরনোর পর দেখা যাচ্ছে জেলার তিনটি আসনেই ভরাডুবি হয়েছে বামেদের। গত বিধানসভা-পঞ্চায়েত-পুরসভার পর লোকসভাতেও তৃণমূলের জয়জয়কার।
কিন্তু, কেন এমন ফল হল? মেদিনীপুরের বাম প্রার্থী প্রবোধবাবু বলেন, “আমরা মানুষের কাছে গিয়ে আমাদের কথা বলেছি। মানুষ যা ভাল বুঝেছেন করেছেন। আমরা মানুষের রায়কে সম্মান জানাচ্ছি।” তাঁর দাবি, “শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ।” একই মত ঘাটালের বাম প্রার্থী সন্তোষ রাণার। তিনি বলেন, “বহু এলাকায় ভোট লুঠ করা হয়েছে। অনেক বুথে আমাদের এজেন্টকে বসতে দেওয়া হয়নি।”
ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী মানস ভুঁইয়া বলেন, “এটা জনগণের রায় নয়। এটা সন্ত্রাস ও পুলিশের ভোট।”
খড়্গপুরের গণনাকেন্দ্রে প্রবোধ পণ্ডা।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এ বার যে একটিও লোকসভা আসন দখলে রাখা যাবে না, তা ভোটের পরই বুঝতে পেরেছিলেন বাম নেতৃত্ব। অবশ্য মেদিনীপুরের আসন নিয়ে তাদের কিছুটা আশা ছিল। বিজেপির চমকপ্রদ উত্থান সেই আশায় জল ঢেলে দিয়েছে। বাম নেতৃত্বের একাংশ এ-ও মানছেন, শুধু তৃণমূলের সন্ত্রাস নয়, সার্বিক ভাবে সাংগঠনিক দুর্বলতার প্রভাবও নির্বাচনে পড়েছে। কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন এলাকায় সংগঠন নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৬৭টি জেলা পরিষদ আসনের মধ্যে মাত্র ২টি বামেদের দখলে আসে। ২৯টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে ২৮টিই দখল করে তৃণমূল। শুধুমাত্র সবং পঞ্চায়েত সমিতির দখল নেয় কংগ্রেস।
তৃণমূলের তারকা প্রার্থী নিয়ে দলের অন্দরে অসন্তোষ কম ছিল না। তবে ভোটের ফলে সেই অসন্তোষের প্রভাব পড়েনি। অবশ্য অনেকেই মনে করেন লোকসভার মতো ভোটে প্রার্থীদের নাম-পরিচিতি তেমন ফ্যাক্টর হয় না। সাংগঠনিক শক্তিতেই জয় আসে। তৃণমূলের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সভাপতি দীনেন রায় বলেন, “তিনটি আসনে বিপুল জয় নিয়ে আমরা নিশ্চিত ছিলামই। আমরা জানতাম, মানুষ সিপিএমকে প্রত্যাখ্যান করবে। তাই হয়েছে।”
গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে একক ভাবে লড়াই করে তৃণমূল বামেদের থেকে ৩৭ হাজার ভোটে এগিয়ে ছিল ঘাটালে। মেদিনীপুরে ১ লক্ষ ২৬ হাজার ভোটে তৃণমূলের থেকে পিছিয়ে ছিল বামেরা। ফলে, ভোটের ফল যে ভাল হবে না, তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি বাম নেতৃত্বের। তবে, ফল যে এতটা খারাপ হতে পারে, তার আগাম আঁচও করতে পারেননি তাঁরা। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এ জেলায় বামেদের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪৪ শতাংশ। দু’বছরের মাথায় ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তা কমে হয় ৩৪ শতাংশ। লোকসভায় তা বেড়ে ৩৮-৩৯ শতাংশ হবে বলেই আশা ছিল তাঁদের। কিন্তু, তা আর হল কই। দিনের শেষে প্রবোধবাবু-সন্তোষবাবুরা তাই বলছেন, “এই ফল সত্যিই অপ্রত্যাশিত। আগামী দিনে বিষয়টি নিয়ে আমরা পর্যালোচনা করব।”