মেদিনীপুরের কলেজ-কলেজিয়েট মাঠে সিপিএমের সভায় ভিড়। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল
রাজ্যে পালাবদলের পরে মেদিনীপুরে সিপিএমের শেষ সমাবেশ হয়েছিল ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। মাঝের তিন বছর আর সমাবেশ করার ঝুঁকিই নেয়নি দল! রবিবার দলের জেলা সম্মেলনের প্রথম দিনের সমাবেশ শেষে অবশ্য সিপিএম নেতৃত্বের মুখে চওড়া হাসি। কারণ, সভার ভিড় ছিল নজরে পড়ার মতো।
গেল বছর এই কলেজ -কলেজিয়েট মাঠেই জেলা বামফ্রন্টের সমাবেশ হয়েছিল। তাতে ভিড়ও হয়েছিল ভালই। তবে জেলা সিপিএম নেতৃত্বের দাবি, এ দিনের ভিড় তাকে ছাপিয়ে গিয়েছে। তাঁদের মতে, এ দিন ৫০ হাজার লোক হয়েছিল। যদিও পুলিশের একটি সূত্রে খবর, জমায়েত ছিল হাজার কুড়ির। লাল ঝান্ডা নিয়ে যে ভাবে কাতারে কাতারে মানুষ সমাবেশে এসেছেন, তাতে উজ্জীবিত নেতৃত্ব। তৃপ্তও। সমাবেশ শুরু হয় দুপুর দু’টোয়। মাঠে দাঁড়িয়ে বেলা একটাতেও খানিক চিন্তায় ছিলেন এক সিপিএম নেতা। বলছিলেন, “বুঝতে পারছি না মাঠ ভরবে কি না!” সময় কিছুটা গড়াতেই সেই নেতার মুখে হাসি। বললেন, “সব প্রতিকূলতা এখনও কাটেনি। তার মধ্যে এমন সমাবেশ করার দুঃসাহস আর কার আছে!”
তাহলে হারানো জনসমর্থন কি ফিরছে? সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক দীপক সরকারের মতে, “মানুষ ভুল বুঝতে শুরু করেছেন। সময় বদলাচ্ছে। মানুষের মধ্যে সাহসও আসছে।”
একদা ‘লালদুর্গ’ বলে পরিচিত পশ্চিম মেদিনীপুরে গত লোকসভা ভোটে ব্যাপক ভরাডুবি হয়েছে সিপিএমের। এই বিপর্যয়ের পর জেলার সদর শহর মেদিনীপুরে সেই ভাবে বড় কর্মসূচি করতে পারছিল না তারা। দলের একাংশ কর্মী- সমর্থক নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তবে এদিন সমাবেশের ছবিটা ছিল অন্য রকম। এ দিনের কর্মসূচিতে দেখা গিয়েছে একসময়ের জেলবন্দি সিপিএম বিধায়ক সুশান্ত ঘোষকেও। জেলা সিপিএমের এক নেতার কথায়, “সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের প্রতিবাদে এখনই মানুষের পথে নামা প্রয়োজন। মানুষ নামছেনও। আমরা নিশ্চিত, গণপ্রতিরোধই পারবে ওদের জনস্বার্থ বিরোধী কাজ প্রতিহত করতে।”
গড়বেতা থেকে আসা মিছিলে বিধায়ক সুশান্ত ঘোষ। ছবি: কিংশুক আইচ।
সিপিএমের সমাবেশে ভিড় নিয়ে অবশ্য তৃণমূল-বিজেপি আদৌ ভাবিত নয়। তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেন রায় বলেন, “ওদের তো কিছু কর্মী- সমর্থক আছেই। তাই কিছু লোক হয়েছে। তবে মানুষ ওদের পাশে নেই!” বিজেপির জেলা সভাপতি তুষার মুখোপাধ্যায় বলেন, “ভিড় আর ভোটকে এক করে দেখলে ভুল হবে। রাজ্যের মানুষ এখন বিজেপিকে বিকল্প হিসেবে দেখছেন। এখন বিজেপিই এগোবে!” জেলা সিপিএমের ২২তম সম্মেলন উপলক্ষে এ দিন মেদিনীপুর কলেজ-কলেজিয়েট মাঠের সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু, রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মদন ঘোষ, সিপিএমের জেলা সম্পাদক দীপক সরকার প্রমুখ। সমাবেশ থেকে প্রত্যাশিতভাবেই বিজেপি-তৃণমূলের সমালোচনা করেন নেতৃত্ব। বিমানবাবু বলেন, “ওরা মাওবাদীদের সঙ্গে গাঁটছাড়া বেঁধে কাজ করেছে। এই জেলাতেই তো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে খুন করার পরিকল্পনা হয়েছিল। তৃণমূল একবারের জন্য হামলা-আক্রমণের নিন্দা করেনি। আসলে এই দল গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না।” তৃণমূলের আমলে শিল্পায়নের গতি রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার অভিযোগও তোলেন বিমানবাবু। তাঁর কথায়, “শালবনিতে জিন্দলদের প্রস্তাবিত বৃহৎ ইস্পাত কারখানা হল না কেন তার জবাব তৃণমূলকেই দিতে হবে। ২০১১ সালে কাদের অর্থে উপরে-নীচে সততার প্রতীক লেখা হোর্ডিং হয়েছিল, তা মানুষ বুঝতে পারছেন।”
সারদা প্রসঙ্গও টেনে আনেন বিমানবাবু। নাম না করে মুকুল রায়কে বিঁধে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকের মন্তব্য, “দিল্লিতে গিয়ে যদি গাঁটছাড়া বেঁধে না আসেন, তাহলে উনি বাইরে থাকবেন না। ওঁর জায়গা জেলেই হবে। আর আমাদের দেখতে হবে, মুখ্যমন্ত্রী মুখে কালো কাপড় লাগিয়ে ঘুরছেন।”
ভিড়ে ঠাসা মেদিনীপুর কলেজ-কলেজিয়েট মাঠ। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।
সূর্যবাবুর আবার কটাক্ষ, “উনি বললেন, একটা মুকুল ঝরলে আমাদের কিছু যায় না। আমাদেল লক্ষ লক্ষ মুকুল আছে। আমি ওঁকে বলেছিলাম, আপনার কাণ্ডজ্ঞানের অভাব আছে। যখন শীত বেশি হয়, আর কুয়াশা ঘন হয়, তখন একটা মুকুল ঝরে না, লক্ষ লক্ষ মুকুলই ঝরে পড়ে।” তিনি আরও বলেন, “জাগো বাংলার সম্পাদক নিজে পদত্যাগ করছেন। আর জাগাবেন কাকে! প্রথম ‘ম’ যিনি জেলে গেলেন (মদন মিত্র), তিনি জেলে গেলেন না হাসপাতালের সুপার হলেন, বোঝা গেল না! পরিবহণমন্ত্রী। বাস অসুস্থ! পরিবহণ অসুস্থ! মন্ত্রীও অসুস্থ!”
তৃণমূলের আমলে মহিলাদের উপর আক্রমণ বেড়েছে বলেও অভিযোগ করেন সিপিএম নেতারা। বিমানবাবু বলেন, “বাংলার বুকে মহিলাদের উপর এত বড় নির্যাতন কোনও দিনও ছিল না। কোনও ক্ষেত্রে এক নম্বর নয়, নারী নির্যাতনে বাংলা এক নম্বর। বঙ্গবাসী হিসেবে লজ্জা হয়।’’ কর্মসংস্থান নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দাবির কথা টেনে সূর্যবাবু বলেন, “দশ লাখের না কি কাজ হয়ে গিয়েছে! হাজার হাজার কারখানা বন্ধ। নতুন কিছু হচ্ছে না। উল্টে পুরনো সব বন্ধ হচ্ছে। তৃণমূল আর বিজেপির কোনও ফারাক নেই। ইনি সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন। উনি আমেরিকা যাচ্ছেন। সিঙ্গাপুর যাতায়াতে যে খরচ হল, সেটাও যদি উঠে আসত বুঝতাম কিছু হয়েছে পশ্চিমবাংলার! উনি হাসপাতালে গেলে শিশুমৃত্যু বাড়ে! আলুর বাজারে গেলে বাজার থেকে আলুও উধাও হয়ে যায়! অন্য দিকে, সব কিছুর দাম বাড়ছে। কমছে শুধু বিমান ভাড়া। দুই সরকারের কী পার্থক্য আছে?”