পরিকল্পনা তৈরি ছিল। পরিকল্পনা মতো ধাপে ধাপে অর্থও বরাদ্দ করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু জেলা কাজ করতে পারেনি। ফলে টানা তিন বছর লোধা সম্প্রদায়ের উন্নয়নে কোনও বরাদ্দ পায়নি পশ্চিম মেদিনীপুর। অবশেষে সেই খরা কাটল। ২০১৩-১৪ আর্থিক বছরের পরিকল্পনা মতো পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার লোধাদের উন্নয়নের জন্য প্রথম ধাপে ১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে জেলা প্রশাসন হাতে পেয়েছে প্রায় ৯ কোটি ৬২ লক্ষ টাকা। এই টাকা যত দ্রুত খরচ করতে পারবে ততই দ্রুত মিলবে বাকি প্রায় ৩ কোটি ৩৭ লক্ষ টাকা।
জেলা অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, লোধাদের বাড়ি নির্মাণ, লোধা অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে পানীয় জলের প্রকল্প তৈরি, সেচের ব্যবস্থা করা ছাড়াও লোধা সম্প্রদায়ের মানুষজনকে স্ব-সহায়ক দলের আওতায় নিয়ে এসে স্বনির্ভর করার জন্যই মূলত এই অর্থ বরাদ্দ করেছে সরকার। কোন এলাকায় কী কী কাজ করা হবে তার জন্য এ বার ব্লক থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ শুরু হয়েছে। জেলা অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ আধিকারিক সৌমেন্দু বিশ্বাস বলেন, “দ্রুত প্রকল্প রূপায়ণের জন্য পদক্ষেপ করা হচ্ছে।”
যাদের উন্নয়নে টাকা বরাদ্দ, সেই লোধারা অবশ্য কাজ হওয়া নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার লোধা শবর কল্যাণ সমিতির সম্পাদক বলাই নায়েক বলেন, “বিগত বামফ্রন্ট সরকারও লোধাদের উন্নয়ন নিয়ে হাজার হাজার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু কিছুই করেনি। বর্তমান সরকারও একই পথে চলছে। সবার বাড়ি নেই, সব গ্রামে পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই, চাকরি নেই, শুধু রয়েছে প্রতিশ্রুতি। ফলে লোধারা থেকে গিয়েছে অন্ধকারেই। দেখি এ বার কতটা কী হয়।”
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় একশো শতাংশ লোধা অধ্যুষিত গ্রামের সংখ্যা ৩৯৮টি। এর বাইরেও বিভিন্ন গ্রামে কিছু কিছু লোধা সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস রয়েছে। জনসংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার। ফলে অন্য জনজাতি সম্প্রদায়ের জন্য যেখানে ১ কোটি বা ২ কোটি টাকা মিলেছে (টোটোদের জন্য ১ কোটি ৩ লক্ষ ৮০ হাজার ও বীরহোড়দের জন্য ২ কোটি ৩৪ লক্ষ ২৪ হাজার), সেখানে লোধা উন্নয়নের জন্য প্রথম ধাপে ৯ কোটি ৬২ লক্ষ টাকা মিলেছে। টাকা মেলায় খুশি হলেও কাজ হবে কিনা তা নিয়ে অবশ্য সংশয়ে রয়েছেন লোধারা।
এই অভিযোগ যে একেবারে অসত্য নয়, তার অবশ্য প্রমাণ রয়েছে। ২০০৭-০৮ থেকে ২০১১-১২ সাল পাঁচ বছরের জন্য লোধা উন্নয়নের একটি সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করেছিল তত্কালীন সরকার। যে প্রকল্পের নাম ছিল ‘সিসিডি’ প্রকল্প বা লোধা সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্প। ৩৭ কোটি টাকার প্রকল্পটি মঞ্জুরও হয়েছিল। ২০০৭-০৮ আর্থিক বছরে তিন ধাপে প্রায় ২ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা পেয়েছিল প্রশাসন। ২০০৮-০৯ আর্থিক বছরে পেয়েছিল সাড়ে ৬ কোটি টাকা। ২০০৯-১০ সালে পেয়েছিল ৩ কোটি ৩১ লক্ষ টাকা। সব মিলিয়ে প্রায় ১২ কোটি টাকা মিলেছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় মেনে সেই টাকা খরচ করতে পারেনি জেলা প্রশাসন। উল্টে বাড়ি তৈরির প্রায় ৩ কোটি টাকা নিয়ে রেখে দিয়েছিল জেলা পরিষদ। একটি টাকাও খরচ করেনি। ২০১২ সালে জেলা পরিষদ থেকে সেই টাকা ফিরিয়ে নেয় অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতর। এখনও প্রায় ১০০টি বাড়ি তৈরির কাজ শেষ হয়নি! তৈরি করা যায়নি সব বাগানও। অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এখনও নারায়ণগড়ে বাগান তৈরির কাজ শেষ করা যায়নি। ফলে বিগত বছরগুলিতে লোধা উন্নয়নের বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছে জেলা। ২০১২ সালে ফের প্রশাসন উদ্যোগী হয়। আবার তৈরি করা হয় ৫ বছরের পরিকল্পনা। ২০১২-১৩ আর্থিক বছর থেকে ২০১৬-১৭ আর্থিক বছরের জন্য ১৪৩ কোটি ৬৯ লক্ষ টাকার প্রকল্প তৈরি করা হয়। যদিও ২০১২-১৩ সালেও পুরনো টাকা খরচের সব হিসেব না দিতে পারায় কোনও বরাদ্দ মেলেনি। তবে ২০১৩-১৪ অর্থ বর্ষের জন্য যে ২৮ কোটি ৬৪ লক্ষ টাকার পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল সেই পরিকল্পনা খাতে ১৩ কোটি টাকা মঞ্জুর হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ৯ কোটি ৬২ লক্ষ টাকা পেয়েও গিয়েছে জেলা। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে, এ বারও কি প্রকল্প রূপায়ণ করতে পারবে জেলা। কারণ, এমনিতেই গত আর্থিক বছরের টাকা পাওয়া গেল চলতি আর্থিক বছরের একেবারে শেষের দিকে। হাতে মাত্র তিন মাস বাকি। এই তিন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারলে ফের অর্থ চাওয়া যাবে। কিন্তু এক্ষেত্রে গড়িমসি হলে ফের মাঝের দু’একটি বছরের টাকা মিলবে না। সে ক্ষেত্রে জেলারই উন্নয়ন ব্যহত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবেন জেলার লোধা সম্প্রদায়ের মানুষ।
প্রশাসন সূত্রে অবশ্য জানা গিয়েছে, এ বার দ্রুত গতিতে প্রকল্প রূপায়ণের পদক্ষেপ করা হচ্ছে। ব্লক থেকে দ্রুত গতিতে উপক্ষোক্তাদের নামের তালিকা সংগ্রহ করা হবে। তারপরই শুরু করে দেওয়া হবে কাজ। প্রশাসনের এক আধিকারিকের কথায়, “বিগত পরিকল্পনা রূপায়িত না হওয়ায় জেলা শুধু ২৫ কোটি টাকা থেকে বঞ্চিত হয়েছে এমন নয়, ২০১২-১৩ আর্থিক বছরেও কোনও বরাদ্দ মেলেনি। এর থেকেও শিক্ষা না নিলে লোধাদের নিয়ে যতই পরিকল্পনা করা হোক না কেন সার্বিক উন্নয়ন অসম্ভব। এমনিতেই রাজ্য সরকারের অর্থ নেই, তার উপর কেন্দ্রীয় সাহায্যও যদি নির্দিষ্ট সময়ে ব্যয় না করতে পারে, বেশি করে টাকা না আনতে পারে, তাহলে কাজ হবে কী ভাবে!” তাই এবার এই প্রকল্পকে গুরুত্ব দিয়েই দেখা হবে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে।