Lok Sabha Election 2024

দেওয়ালে আঁকা ব্যঙ্গচিত্রের ছিল ‘গা জ্বালানো’র ক্ষমতা

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫২ সালে প্রথম নির্বাচন হয়। তখন পোস্টার, লিফলেট ছাপানোর খরচ ছিল অনেক বেশি। খরচ কমাতে দেওয়ালে প্রচার শুরু করে কংগ্রেস ও বামপন্থীরা।

Advertisement

আনন্দ মণ্ডল , দিগন্ত মান্না

তমলুক, পাঁশকুড়া শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:০৯
Share:

ব্যঙ্গচিত্র।

তখন হাতে হাতে স্মার্টফোন ছিল না। ২৪ ঘণ্টার খবরের কোনও চ্যানেলের জন্মও হয়নি। ভোট প্রচারের অন্যতম মাধ্যম ছিল দেওয়ালে লেখা ব্যঙ্গচিত্র ও ছড়া। ভোট এলেই চেনা এলাকাও অচেনা হয়ে উঠত নানা রকমের দেওয়াল চিত্রে।

Advertisement

সময় বদলেছে। বদলেছে ভোট প্রচারের পদ্ধতিও। নির্বাচন কমিশনের কড়াকড়িতে এখন আর অনুমতি ছাড়া কারও বাড়ির দেওয়াল ভোট প্রচারের দেওয়াল লিখনের জন্য ব্যবহার করা যায় না। কমেছে দেওয়াল লিখন। ভোটের আগে ব্যঙ্গচিত্র এঁকে বাড়তি আয় করা শিল্পীরা চলে গিয়েছেন বিকল্প পেশায়। ভোটের ব্যঙ্গচিত্র ও ছড়া এখন দেখা যায় সমাজমাধ্যমে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫২ সালে প্রথম নির্বাচন হয়। তখন পোস্টার, লিফলেট ছাপানোর খরচ ছিল অনেক বেশি। খরচ কমাতে দেওয়ালে প্রচার শুরু করে কংগ্রেস ও বামপন্থীরা। সেই শুরু ভোটের দেওয়াল লিখন। ষাটের দশকে ব্যঙ্গচিত্র ও ছড়া ভোটের দেওয়াল লিখনকে অন্য মাত্রা দেয়। তখন কংগ্রেসের প্রতীক ছিল জোড়া বলদ। সেই ছবি এঁকে তারা লিখত— "ভোট দেবেন কোথায়/ জোড়া বলদ যেথায়।" কংগ্রেসের পাল্টা দেওয়াল লিখনে সিপিএম লিখত, "জোড়া বলদের দুধ নেই/ কংগ্রেসের ভোট নেই।"

Advertisement

সময়টা ১৯৭২ সাল। কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের সরকার। রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচনে এক দিকে কংগ্রেস ও সিপিআই জোট , অন্য দিকে সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট জোট। সেই বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ও সিপিআই-এর মধ্যে জোট সমীকরণ নিয়ে সিপিএমের দেওয়াল লিখনে ফুটে উঠেছিল এমন স্লোগান।

একদা বাংলার রাজনীতির অন্যতম ভরকেন্দ্র ছিল তমলুক শহর। তমলুকের প্রবাদ প্রতিম কংগ্রেস নেতা অজয় মুখোপাধ্যায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন এখান থেকে জিতেই। আবার সিপিআইয়ের প্রবাদপ্রতীম নেতা ছিলেন বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী গীতা মুখোপাধ্যায়। বিশ্বনাথ ছিলেন অজয়ের নিজের ভাই। তমলুকের প্রবীণ বাসিন্দাদের মতে, সত্তরের দশক থেকে ভোটের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে দেওয়াল লিখন ঘিরে যুযুধান শিবিরের প্রতিযোগিতা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করে। সেই সময়ের দেওয়াল লিখন এবং প্রার্থীদের প্রচারের স্মৃতিচারণা করে শহরের মালীজঙ্গল বাসিন্দা জয়দেব মালাকার বলেন,’’তখনও তমলুক শহরের অনেক বাড়ি মাটির ছিল। শহরের কোর্ট পাড়ায় অফিসের পাঁচিল ও জেলখানার দেওয়াল সহ আশেপাশের বাড়ির দেওয়ালে প্রার্থীদের সমর্থনে লেখা ও আঁকা হত। কংগ্রেস, সিপিআই, সিপিএম—সকলেই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে স্লোগান লিখত।

জয়দেব বলেন, ‘‘১৯৭২ সালে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ও সিপিআইয়ের মধ্যে জোট হয়েছিল। আর বিরোধী জোটের নেতৃত্বে ছিল সিপিএম। তখন সিপিএমের স্লোগান ছিল, ‘দিল্লি থেকে এল গাই ( কংগ্রেসের তখন প্রতীক ছিল গাই-বাছুর) সঙ্গে বাছুর সিপিআই।’ কংগ্রেস লিখত, ‘চিনের কাস্তে-হাতুড়ি-তারা, দেশের মানুষ বিচার করুন দেশের শত্রু কারা।’ এ ছাড়াও কংগ্রেসের আরও স্লোগান ছিল,’যবতক সুরজ চাঁদ রহেগা, ইন্দিরা তেরা নাম রহেগা’। জয়দেব জানান, সেই সময়ে তমলুক শহরে নানা জায়গায় কংগ্রেসের হয়ে ছড়া দিয়ে দেওয়াল লিখতেন অনিল পট্টনায়েক (বাদল) সহ কয়েকজন শিল্পী। আর সিপিএমের হয়ে দেওয়াল লিখতেন ধনঞ্জয় সামন্ত ও মৃত্যুঞ্জয় সামন্ত। ১৯৮০ সালের লোকসভা নির্বাচনে তমলুক লোকসভা কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রার্থী ছিলেন শ্যামাদাস ভট্টাচার্য । তাঁর হয়ে দেওয়াল লিখেছিলেন তমলুকের শিল্পী সনাতন দাস। সনাতন বলেন, ’’আমি তখন নেহাত তরুণ। দৈনিক ১৫ টাকা পারিশ্রমিক ও খাওয়া পেতাম। রঙ বলতে ভুষো কালি, হলুদ, সবুজ ও লাল কালি। সাধারণত সন্ধ্যার পর থেকে রাত পর্যন্ত হ্যারিকেন জ্বেলে দেওয়াল লিখতাম।’’ তিনি আরও বলেন, তমলুক শহরের জেলখানা মোড় ও আদালতের পাঁচিলের দেওয়াল ছাড়াও সরকারি অফিসগুলির দেওয়ালে লিখতাম।’’

সনাতনের কথায়, ’’১৯৮০ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের হয়ে দেওয়াল লিখলেও ১৯৮২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের হয়ে দেওয়াল লিখেছি। তাঁর জন্য পারিশ্রমিক নেওয়া হয়নি। কারণ আমি সিপিআইয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সিপিআই নেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় আমাকে খুব ভালবাসতেন। ১৯৭৭ সালে লোকসভা ভোটের সময়ে বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ছাত্রকে দেওয়াল লিখনের জন্য তমলুকে এনেছিলেন। তাঁদের কাজ আমি দাঁড়িয়ে দেখতাম। ওই সময় থেকে তমলুকে ভোটের দেওয়াল লিখন ও ছবির চল বাড়তে থাকে।’’

২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ট্রেনের ছবি এঁকে তৃণমূল লিখেছিল, ‘আপ ১৯৭৭ ডাউন বাম এক্সপ্রেস স্টেশন ছাড়ছে/ ২০১১ আপ মা মাটি মানুষ এক্সপ্রেস স্টেশনে ঢুকছে’। সময় বদলেছে। ভোটের সময় এখন আর ব্যঙ্গচিত্র খুব একটা নজরে পড়ে না। ব্যঙ্গচিত্র এঁকে ভোটের আগে আয় করতেন যে সব শিল্পীরা তাঁরা কাজ পান না। পাঁশকুড়ার ডালপাড়া গ্রামের চিত্রশিল্পী শম্ভু চক্রবর্তী বলেন, বছর দশেক আগে থেকে ব্যঙ্গচিত্রের বরাত কমতে শুরু করে। এখন একেবারেও বন্ধ।"

তৃণমূলের তমলুক লোকসভা নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যান সৌমেন মহাপাত্র বলেন, ‘‘আগে আমরা নিজেরা ছড়া রচনা করতাম।’’ তমলুক কেন্দ্রের এসইউসি প্রার্থী নারায়ণচন্দ্র নায়কের কথায়, ‘‘ব্যঙ্গচিত্র আঁকার মতো বড় দেওয়ালই এখন পাওয়া যায় না।’’ ভোটের বাজারে বিরোধীদের গা জ্বালানোর যে ক্ষমতা দেওয়ালে আঁকা ব্যঙ্গচিত্রের ছিল তা সমাজমাধ্যমে ব্যঙ্গ বা স্লোগানে নেই, তা মানছেন সমস্ত দলের নেতারাই। (চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement