ঘাগরায় স্থানীয় পাথরের বাসন দোকানে পর্যটকদের কেনাকাটা। রবিবার। নিজস্ব চিত্র
একে বড়দিন, তার উপরে রবিবার। দুইয়ের মিশেলে বেলপাহাড়ির বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে এদিন পর্যটকদের ভিড় উপচে পড়ল। যা স্থানীয়দের মুখে হাসি ফোটালেও কিছুটা উদ্বেগও বাড়াল। কারণ করোনা নিয়ে সতর্কতা জারি হলেও এদিন বেশিরভাগ পর্যটকের মুখেই মাস্ক ছিল না।
বড়দিন উপলক্ষে ঘাগরা, খাঁদারানি, কাঁকড়াঝোরে খাবার, কারুশিল্পের পসরা নিয়ে বসেছিলেন স্থানীয়রা। বিক্রিবাটাও হল দেদার। বছর খানেক আগেও ঝাড়গ্রামের পর্যটন ব্যবসা ছিল মূলত জেলাশহর কেন্দ্রিক। এদিন দেখা গেল পর্যটন ব্যবসায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লাভবান হচ্ছেন স্থানীয় আদিবাসী মূলবাসীরাও। ঝাড়গ্রাম ডিস্ট্রিক্ট হোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মধুসূদন কর্মকার মানছেন, ‘‘পর্যটন ব্যবসার বিস্তৃতি এখন জেলা শহর ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতেও। এর ফলে স্থানীয়রা বেশি উপকৃত হচ্ছেন।’’
এদিন কাঁকড়াঝোরে গিয়ে দেখা গেল সরকারি গেস্ট হাউস ও বেসরকারি হোম স্টেগুলি পর্যটক ভর্তি। কাঁকড়াঝোরের সরকারি গেস্ট হাউসের ম্যানেজার অনুপম মণ্ডল বললেন, ‘‘যত বেশি পর্যটক আসবেন তত স্থানীয়দেরই লাভ। সরকারি গেস্ট হাউসের সব ঘরে পর্যটক আছেন। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সব ঘর অগ্রিম বুকিং। এছাড়াও বড়দিনে কাঁকড়াঝোরে বেড়াতে আসা প্রায় পঞ্চাশ জন পর্যটক এদিন সরকারি গেস্ট হাউসের কিচেনে খাবার অর্ডার দিয়েছিলেন।’’ অতিথিশালার পাচক ব্যোমকেশ মণ্ডল জানালেন, এদিনের মেনুতে ছিল ভাত, পোস্তবড়া, বেগুনভাজা, ডাল, আলুপোস্ত, বাঁধাকপির তরকারি, দিশি মুরগির ঝোল, চাটনি, দই, পাঁপড়, মিষ্টি। যা খেয়ে তারিফ করেছেন পর্যটকেরা। কলকাতার সোমা ঠাকুরতা, অমিতাভ ঠাকুরতা বলছেন, ‘‘সরকারি অতিথিশালাটির খাবারের মান খুব ভাল। তবে ঘর বেশি নেই। তাই যাঁরা কেবলমাত্র দুপুরের খাবারের জন্য গিয়েছিলেন, তাঁদের সমস্যায় পড়তে হয়েছে। কারণ, ওই অতিথিশালার কমন শৌচাগার মাত্র একটি।’’
ঢাঙ্গিকুসুমের হদহদি ঝরনা দেখতে আসা কলকাতার ভবানীপুরের ব্রজমোহন দত্ত, বজবজের শুচিতা সাহারায়দের কথায়, ‘‘ঝাড়খণ্ড সীমানায় আমাদের রাজ্যে এত সুন্দর প্রাকৃতিক ঝরনা যে রয়েছে আগে জানতাম না।’’ একই সঙ্গে তাঁদের আক্ষেপ, এখানে পর্যটকদের জন্য কার্যত কোনও পরিকাঠামোই নেই। এদিন ঘাগরায় পর্যটক ও পিকনিক পার্টির কয়েকশো গাড়ি এসেছিল। পার্কিংয়ের দায়িত্বে থাকা ঘাগরা বন সুরক্ষা কমিটির সদস্য কুমার মান্ডি বললেন, ‘‘প্রচুর পর্যটক আসায় স্থানীয়রা দুটো টাকার মুখ দেখছেন। কেউ চপ, কেউ আইসক্রিম বিক্রি করছেন। কেউবা পর্যটকদের খাবার ব্যবস্থা করছেন।’’
ঘাগরায় পসরা নিয়ে বসেছিলেন শিমূলপালের পাথরশিল্পী অরুণ মিস্ত্রি। স্থানীয় পাথর কেটে পাথরের থালা, বাটি, প্রদীপ দেবদেবীর মূর্তি তৈরি করেন অরুণ। দোকান সামলাচ্ছিলেন তাঁর স্ত্রী মীরা মিস্ত্রি। দু’জনেই জানালেন, শনিবার কয়েক হাজার টাকার বিক্রি হয়েছিল। রবিবার তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। অরুণের কথায়, ‘‘গ্রামে যে থালা-বাটির কদর নেই, সেগুলোই কলকাতার পর্যটকরা দু’শো টাকা পিস দরে কিনছেন। এভাবেই যেন পর্যটক আসেন।’’ বেলপাহাড়ির অজয় দে খাবারের স্টল দিয়েছেন সেখানে। মিলছে মুড়ি, গরম চপ, পেঁয়াজি, ঘুগনি, ডিম সেদ্ধ। এছাড়াও আছে স্থানীয় নলেন গুড়ের পাটালি। অজয় জানালেন, ২ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি ঘাগরায় বসবেন। প্রতিদিনই ভাল বিক্রি হচ্ছে। অজয়ের কথায়, ‘‘এক সময়ে সন্ত্রাসের আবহে মানুষজন ঘরবন্দি থাকতেন। সেই ভয়ের দিন অতীত। করোনায় ব্যবসার ক্ষতি এবার পুষিয়ে দিচ্ছে পর্যটকদের ঢল।’’
খাঁদারানিতেও কার্যত তিলধারণের জায়গা ছিল না এদিন। ঝিলের একদিকে পর পর পিকনিক হয়েছে। কলকাতা থেকে বেড়াতে আসা দেবশরণ চক্রবর্তী, জাগৃতি মুখোপাধ্যায়রা বলেন, ‘‘জঙ্গল-পাহাড়ের এই পরিবেশের মাঝে দারুণ উপভোগ্য অনুভূতি হচ্ছে। তবে পর্যটকদের জন্য শৌচাগার, পানীয় জল, বিশ্রামের জায়গা প্রয়োজন।’’