নেতাইয়ের শহিদবেদি। ফাইল চিত্র
পঞ্চায়েত ভোটের আগে নেতাইয়ের রাশ যেন আলগা না হয়!
তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে জেলা নেতৃত্বকে এমনই বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে সূত্রের খবর। নির্দেশ পেয়েই তৎপরতা শুরু হয়েছে জেলা তৃণমূলের অন্দরে। আগামী ৭ জানুয়ারি নেতাই দিবসে শহিদ স্মরণ অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতিও শুরু করেছে তৃণমূল। সেদিন সবার আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিনিধিরাই যাতে শ্রদ্ধা জানাতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করতে শীঘ্রই দলের বৈঠক ডাকতে চলেছেন জেলা তৃণমূলের সভাপতি দুলাল মুর্মু।
একসময়ে নেতাই কাঁটায় বিদ্ধ ছিল সিপিএম। আর এখন সেই নেতাই কার্যত তৃণমূলের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ গোষ্ঠীকোন্দল এবং অবশ্যই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নেতাই নিয়ে শাসক-বিরোধী টানাপোড়েন। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি লালগড় ব্লকের কংসাবতী নদীর কূল ঘেঁষা নেতাই গ্রামের গণহত্যার ঘটনায় উত্তাল হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি। সিপিএমের দলীয় শিবির থেকে গুলি চালানোর অভিযোগ উঠেছিল। গুলিতে মৃত্যু হয় চার মহিলা-সহ ৯ গ্রামবাসীর। জখম হন ২৮ জন। সে সময়ে নেতাই নিয়ে আন্দোলনকে সংগঠিত করেছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। প্রথম তিনিই গিয়েছিলেন নেতাই গ্রামে। পরদিন এসেছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
নেতাই কাণ্ডে অভিযুক্ত সিপিএমের একাধিক নেতা-কর্মী এখনও জেলবন্দি। ওই ঘটনায় সিপিএমের সশস্ত্র শিবিরের তত্ত্বকে সামনে এনে বিগত নির্বাচনগুলিতে জঙ্গলমহলের বিপুল জনসমর্থন তৃণমূলের অনুকুলে এসেছে। কিন্তু পরিস্থিতি এখন অনেকটাই আলাদা। নেতাইয়ের ক্ষোভের ক্ষত ক্রমেই বাড়ছে। নেতাইয়ের জন্য বিপুল উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলেও সেখানকার একাংশ গ্রামবাসী এখনও শুভেন্দুকে তাঁদের পুরনো দিনের বন্ধু হিসেবেই মনে করেন। গেরুয়া শিবিরে গেলেও শুভেন্দুকে তাঁরা কখনই রাজনীতির লোক হিসেবে দেখেন না। একাংশ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই কারণেই ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি তৎকালীন তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক ছত্রধর মাহাতোর হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও শুভেন্দু নেতাই গ্রামে সবার প্রথমে ঢুকে শহিদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। চলতি বছরের নেতাই দিবসে অবশ্য পুলিশের বাধায় নেতাই গ্রামে ঢুকতে পারেননি বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু। সেদিন প্রতিমন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদা সম্পর্কে শুভেন্দুর মন্তব্যের জেরে অনেক জলঘোলা হয়েছে। শুভেন্দুর বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগও দায়ের করেছেন প্রতিমন্ত্রী। এবার শুভেন্দু আদালতের নির্দেশ নিয়ে আঁটঘাঁট বেঁধেই নেতাই গ্রামে আসতে পারেন বলে আশঙ্কা করছে তৃণমূল। পাশাপাশি, আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিষয়টিও ভাবাচ্ছে তাদের।
মাস চারেক আগে লালগড় ব্লক তৃণমূল সভাপতির পদ থেকে শ্যামল মাহাতোকে সরিয়ে তারাচাঁদ হেমব্রমকে আনা হয়েছে। কিছুদিন আগে লালগড়ের পাঁচটি অঞ্চলের দলীয় সভাপতি বদল হয়। যা নিয়ে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। লালগড়ে ব্লক ও অঞ্চলগুলিতে দলের নবাগতরা বিধায়ক তথা প্রতিমন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদার ঘনিষ্ঠ অভিযোগ তুলেছেন দলের একাংশ। বিরবাহার নাম না-করে কার্যত তিনিই দলকে শেষ করে দিচ্ছেন বলে সমাজমাধ্যমে কটাক্ষ পোস্ট করেছিলেন নেতাই শহিদ স্মৃতিরক্ষা কমিটির সম্পাদক সরজিত রায়। ওই পোস্ট করার পরদিনই লালগড় অঞ্চল যুব সভাপতির পদ থেকে সরজিতকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর পাল্টা হিসেবে এলাকার বিধায়ক তথা প্রতিমন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদাকেও শহিদ স্মৃতিরক্ষা কমিটির উপদেষ্টা কমিটির পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। যা নিয়ে চিন্তিত তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
তৃণমূল সূত্রের খবর, পরিস্থিতি বুঝেই আগেভাগে বার্তা পাঠিয়েছেন শীর্ষ নেতৃত্ব। নেতাই দিবসে দলের নেতা-জনপ্রতিনিধি ও কর্মীরা নির্বিবাদে নেতাই গ্রামে গিয়ে স্মৃতি তর্পণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে পারেন সে ব্যাপারে জেলা সভাপতি দুলাল মুর্মুকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুলাল বলছেন, ‘‘নেতাই দিবসের অনুষ্ঠানের জন্য শীঘ্রই ব্লকের নেতাদের নিয়ে বৈঠক ডাকা হবে। নেতাই শহিদ স্মৃতিরক্ষা কমিটির সঙ্গেও আলোচনা করব।’’ স্মৃতিরক্ষা কমিটির সম্পাদক সরজিত রায় বলছেন, ‘‘প্রতিবছর শহিদ স্মৃতিরক্ষা কমিটির উদ্যোগেই শহিদ তর্পণের অনুষ্ঠান হয়। এবার কীভাবে অনুষ্ঠান হবে সে ব্যাপারে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তৃণমূলের যে সব নেতা-নেত্রী-সহ যাঁরা দুর্দিনে আমাদের পাশে ছিলেন, তাঁরা অবশ্যই স্বাগত।’’ তিনি জুড়েছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে কেউ এলে আমরা সবচেয়ে বেশি খুশি হব।’’