ঝাড়গ্রামের গড়শালবনি গ্রামে বনকর্মীদের ঘিরে গ্রামবাসীর বিক্ষোভ। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
নয়া নিয়মে বাড়ছে ক্ষোভ!
লোকালয়ে হাতি ঢুকলে হুলাপার্টির দেখা মিলছে না। গ্রামবাসীরা হাতি তাড়াচ্ছেন বটে, তবে কোনও রকম সরঞ্জাম ছাড়াই। এতদিন এলাকায় হাতি ঢুকলে বন দফতরের কর্মী ও নিজস্ব হুলা পার্টিকে কাজে লাগানো হত। অনেকক্ষেত্রে হাতি তাড়ানোর কাজে লাগানো হত স্থানীয় অভিজ্ঞ গ্রামবাসীদেরও। গ্রামে হাতি ঢুকলে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে স্থানীয় রেঞ্জারের অফিস থেকে গ্রামবাসীদের প্রয়োজনীয় মশাল, পটকা দেওয়া হত। গত এপ্রিল মাসে হাতি খেদানোর জন্য এলাকা ভিত্তিক এজেন্সি নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয় বন দফতর। হুলা পার্টির প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার জন্য অর্থ বরাদ্দের নিয়মেও পরিবর্তন করা হয়। নতুন নিয়ম এখনও কার্যকর না হলেও বন দফতরের রেঞ্জ অফিসগুলি থেকে হাতি তাড়ানোর সরঞ্জাম পাচ্ছেন না গ্রামবাসীরা। বাড়ছে ক্ষোভ। এ বিষয়ে রাজ্যের বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মণ বলেন, “নতুন ট্রেজারি-পদ্ধতি কার্যকর করতে কিছুটা সময় লাগবে। সে জন্যই আপত্কালীন প্রয়োজনের জন্য প্রত্যেক ডিএফও-র কাছে পাঁচ লক্ষ টাকা অগ্রিম বরাদ্দ রাখার ব্যাপারে বিভাগীয় স্তরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ জন্য অর্থ দফতরের অনুমোদনও চাওয়া হয়েছে।”
সোমবার বিকেলে ঝাড়গ্রামের গড়শালবনি ও আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামের লোকেরা একটি বুনো রেসিডেন্ট হাতিকে খেদিয়ে অরণ্যশহরে ঢুকিয়ে দেয় বলে স্থানীয়দের দাবি। তবে শেষ পর্যন্ত শহরের পুরনো ঝাড়গ্রাম এলাকার বাসিন্দাদের প্রতিরোধে হাতিটি পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরে বনকর্মীরা এসে হাতিটিকে খেদিয়ে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যায়। এ দিন কোনও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেনি। স্থানীয় সূত্রে খবর, ঝাড়গ্রাম শহরের আশেপাশে গড়শালবনি, নেদাবহড়া, বোরিয়া, ঘৃতখাম, চিচুরগেড়িয়া, গাডরো, শিরষি, পেনিয়াভাঙা, জিতুশোল, কয়মা, কামারবাঁধির মতো গ্রামগুলিতে গত কয়েক মাস ধরে পাঁচটি রেসিডেন্ট হাতির উপদ্রব বেড়েছে। এলাকার গ্রামগুলিতে যখন তখন ঢুকে পড়ছে হাতিরা। ক্ষয়ক্ষতির জেরে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যে কার্যত দিনে-রাতে সব সময়ই সজাগ থাকতে হচ্ছে গ্রামবাসীদের।
গত বছর ঝাড়গ্রামের ওই সব গ্রামের বাসিন্দাদের সাহায্য নিয়ে এলাকা থেকে রেসিডেন্ট হাতিদের তাড়িয়েছিল বন দফতর। হাতি তাড়ানোর জন্য টাকাও পেয়েছিলেন অভিযানে অংশ নেওয়া প্রত্যেক গ্রামবাসী। এ বার নয়া নিয়মে বেড়েছে সমস্যা। মঙ্গলবার গড়শালবনি গ্রামে হাতির হানায় ক্ষয়ক্ষতি সরেজমিনে পরিদর্শন করতে গিয়ে গ্রামবাসীর বিক্ষোভের মুখে পড়েন বন কর্মীরা। দীর্ঘক্ষণ তাঁদের ঘেরাও করে রাখা হয়।
বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, আগে প্রতিটি রেঞ্জ অফিসে ‘ফরেস্ট অ্যাডভান্স’ হিসেবে অগ্রিম টাকা বরাদ্দ করা হতো। রেঞ্জ অফিসগুলিতেও পটকা ও পোড়া মোবিল মজুত রাখা হতো। এ ছাড়াও মজুত রাখা হতো চটে জড়ানো লোহার তৈরি হুলা (মশাল)। এলাকায় হাতি ঢুকলে গ্রামবাসীরা ভিড় করতেন রেঞ্জ অফিসে। গ্রামবাসীদের হাতে সরাসরি পটকা ও পোড়া মোবিল দেওয়া হতো। এলাকার বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যদের চাহিদা অনুসারে হুলাও দেওয়া হত। কিন্তু রাজ্য সরকারের নতুন নিয়মে এই ব্যবস্থার কার্যত ইতি হয়েছে।
চলতি আর্থিক বর্ষের গত এপ্রিল মাস থেকে হাতি খেদানোর দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে এজেন্সির হাতে। ঠিক হয়েছে, হাতি খেদানোর জন্য এলাকা ভিত্তিক এজেন্সি নিয়োগ করবে বন দফতর। হুলা পার্টির সদস্য কারা হবেন, সেটাও ঠিক করবে সংশ্লিষ্ট এজেন্সি। হাতি খেদানোর পরে সেই বিল রেঞ্জ অফিস থেকে পাঠানো হবে ডিএফও-র কাছে। ডিএফও বিলটি অনুমোদন করে পাঠাবেন ট্রেজারিতে। তারপর টাকা আসবে সরাসরি এজেন্সির কাছে। অথবা, হুলাপাটির সদস্যদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা চলে আসবে। একই ভাবে, গ্রামবাসীদের চাহিদা অনুযায়ী রেঞ্জ অফিস থেকে পটকা ও পোড়া মোবিলের জন্য চাহিদার তালিকা পাঠানো হবে ডিএফও-র কাছে। ডিএফও ছাড়পত্র দিলে ট্রেজারি থেকে টাকা পাওয়া যাবে। বন দফতর সূত্রের খবর, নির্দিষ্ট গাইড লাইনের অভাবে এখনও বিভিন্ন রেঞ্জে এজেন্সিই নিয়োগ করা হয়নি। হাতির হানা ঠেকাতে গ্রামবাসীদের সরঞ্জামও দেওয়া সম্ভব হয়নি। হাতি তাড়ানোর সরঞ্জাম না পেয়ে জঙ্গলমহলের গ্রামবাসী ক্ষোভে ফুঁসছেন।
গত বছর মে-জুন মাসে বন দফতরের ঝাড়গ্রাম ও লোধাশুলি রেঞ্জ অফিস থেকে এলাকার বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দাদের হাতি খেদানোর হুলা জ্বালানোর জন্য মোট ১ হাজার একশো পঁচিশ লিটার পোড়া মোবিল দেওয়া হয়েছিল। এ বার এক ফোঁটাও পোড়া মোবিল দেওয়া সম্ভব হয়নি। গড়শালবনির পানু মাহাতো, শিবু মাহাতো, থাপা মাহাতো-রা বলেন, “বন দফতর হাতিও তাড়াচ্ছে না। আমাদের সরঞ্জামও দিচ্ছে না। আমরা কোথায় যাব!”