রাস্তার পাশের মরা শালগাছ। দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি।
রাস্তার ধারে একের পর এক মরা শালগাছে হতশ্রী অবস্থা অরণ্যশহরের। ঝাড়গ্রাম শহরে উদ্বেগজনক হারে কমে যাচ্ছে শালগাছের সংখ্যা। অভিযোগ, শহরের রাস্তার ধারে জায়গা দখলের জন্য নির্বিচারে কৌশলে মেরে ফেলা হচ্ছে অসংখ্য শালগাছ। আবার উন্নয়নের দোহাই দিয়ে শহরের বিভিন্ন এলাকায় শয়ে শয়ে শালগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, শালগাছ কাটা হলে বিকল্প এলাকায় দ্বিগুণ সংখ্যক শাল গাছের চারা রোপণের কথা। কিন্তু শহরে নতুন করে কোনও শাল গাছ রোপণ করা হয়নি।
অথচ ঝাড়গ্রামই রাজ্যের একমাত্র শহর, যেখানে সংরক্ষিত ও সংগঠিত বনাঞ্চল রয়েছে। এক সময় অরণ্যশহরে রাস্তার দু’ধারে ছিল অগুন্তি শালগাছের সারি। যত দূর দেখা যেত শুধুই সবুজ। সেই কারণেই পর্যটকদের কাছে ‘অরণ্যশহর’-এর আকর্ষণ অনেক বেশি। কিন্তু গত কয়েক বছরে ছবিটা পাল্টে গিয়েছে। অরণ্যশহরের মূল আকর্ষণ রাস্তার দু’ধারের শালগাছের সংখ্যা এখন কার্যত হাতে গোনা!
১৯২২ সালে যখন ঝাড়গ্রাম মহকুমাসদর গঠিত হয়, তখন ঘন শালজঙ্গল কেটেই তৈরি হয়েছিল মহকুমাশাসকের দফতর ও অন্যান্য অফিস-কাছারি এবং জনবসতি গড়ে ওঠে। তা সত্ত্বেও রাস্তার দু’ধারে ঘন শাল গাছের সারিই ছিল ঝাড়গ্রামের মূল আকর্ষণ। এ ছাড়া শহরের বিভিন্ন সরকারি চত্বরে ও বেসরকারি জমিতে অজস্র শালগাছ ছিল। সেই শাল গাছই এখন অস্তিত্বের সঙ্কটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।
পুরসভার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৮ সালে ২১ বর্গকিলোমিটার আয়োতনের শহরে বনাঞ্চলের পরিমাণ ছিল ৮ বর্গ কিলোমিটার। ২০০৬ সালে তৎকালীন বাম পুরবোর্ড একটি বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের সাহায্য সমীক্ষা করিয়েছিল। পুরসভার ওই সর্বশেষ সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৬ সালে অরণ্যশহরে সব মিলিয়ে সবুজের পরিধি ছিল মাত্র ৩ বর্গ কিলোমিটার। তারপর আর কোনও সমীক্ষা করা হয়নি। পুরসভা সূত্রের খবর, ২০০৬ সালে শহরে সবুজের পরিমাণ ছিল ১৬ শতাংশ। পরিবেশ কর্মীদের দাবি, গত পাঁচ বছরে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে যে হারে শহরে শালগাছ কেটে ফেলা হয়েছে এবং কৌশলে মেরে ফেলা হয়েছে, তাতে সবুজের পরিমাণ আরও কমে গিয়েছে। অভিযোগ, শহরের ঐতিহ্যের শালগাছগুলিকে রক্ষার জন্য সরকারি স্তরে কোনও উদ্যোগ নেই। বরং উন্নয়নের নামে নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে শাল গাছ। ২০১৩ সালে তৃণমূলের পুরবোর্ড ক্ষমতায় আসার পরেও শহরের সবুজ ফেরাতে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ।
ইতিমধ্যে প্রায় দু’শো শাল গাছ কেটে ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামের সম্প্রসারণ ও নতুন স্পোর্টস্ কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছে। হাসপাতাল চত্বরে নার্সিং ট্রেনিং স্কুল ভবন এবং সিএমওএইচ অফিস তৈরির জন্য আড়াইশোরও বেশি শালগাছ কাটা হয়েছে। ঝাড়গ্রামের কদমকানন এলাকায় পুলিশ সুপারের অফিস তৈরির জন্য শতাধিক শাল গাছ কাটা হয়েছে। এ ছাড়া গত পাঁচ বছরে রাস্তা সম্প্রসারণের জন্যও অনেক শালগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এর পাশাপাশি, শহরের মেন রোড-সহ বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার ধারে থাকা অজস্র প্রাচীন গাছের গোড়ায় মোবিল, হিং, চুন দিয়ে অথবা লোহার গজাল পুঁতে শালগাছ গুলিকে মেরে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ। রাস্তার ধারের দোকান ও বাড়ির প্রবেশ পথের সামনেটা ফাঁকা রাখতে এভাবে সবুজ ধ্বংস চলেছে। শালগাছ মেরে সরকারি জায়গা দখলের ঘটনাও ঘটছে। রাস্তার ধারে মরা শালগাছ গুলি বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক বার মরা শাল গাছ ভেঙে পড়ে মারাত্মক দুর্ঘটনাও ঘটেছে।
বন দফতর সূত্রের দাবি, শহরে রাস্তার ধারের শালগাছের মালিক পূর্ত দফতর ও পুরসভা। পূর্ত দফতরের ঝাড়গ্রাম মহকুমার অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার প্রদীপ বিশ্বাস বলেন, “রাস্তার ধারে বড় বড় শাল গাছ মরে গিয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। মরা গাছ গুলি কাটার জন্য টেন্ডার ডাকা হবে।” ঝাড়গ্রাম পুরসভার উপ পুরপ্রধান শিউলি সিংহ বলেন, “শালগাছ শহরের সৌন্দর্য ও সম্পদ। নতুন করে শালগাছের চারা রোপণের জন্য পুরসভার বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে শহরবাসীকেও সচেতন হতে হবে।”
শহরের প্রবীণ নাগরিক সন্ন্যাসী কর্মকার, লিপিকা চক্রবর্তীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “শালগাছের জন্যই তো এই শহরকে অরণ্যসুন্দরী বলা হয়। কিন্তু সেই সৌন্দর্য তো আর আগের মতো নেই! প্রশাসনের এ ব্যাপারে নজর দেওয়া উচিত।” তাঁদের দাবি, আগে শহরের মেন রোডে এবং পুরাতন ঝাড়গ্রাম, রঘুনাথপুর, ঘোড়াধরা, বাছুরডোবা, রবীন্দ্রপার্কের মতো বিভিন্ন এলাকায় ও রাস্তার দু’ধারে প্রতি মিটারে কমপক্ষে ৪-৫টি গাছ দেখা যেত। এখন অনেক জায়গাতেই প্রতি ৫ মিটারেও এক খানা গাছ নজরে পড়ে না।
পরিবেশ কর্মী সুভাষ দত্ত’র কথায়, “উন্নয়নের দোহাই দিয়ে সরকারি ভাবে গাছ কাটার প্রতিযোগিতা চলেছে। বেআইনি ভাবেও অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। শহরের ৪৩ শতাংশ শালগাছ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।” সুভাষবাবুর পর্যবেক্ষণ, এভাবে বেপরোয়া বৃক্ষ নিধন চলতে থাকলে খুব শিগগিরই ‘অরণ্যশহর’ নামটি ইতিহাসের পাতায় জায়গা নেবে।