দুর্নীতির দুর্বি-পাঁক
Calcutta High Court

পড়ুয়াদের চোখে অসম্মান অসহ্য

পূর্ব মেদিনীপুরে নিয়োগ বাতিল হয়েছে ৩০ জনের। সেই তালিকায় ছিলেন পাঁশকুড়া একটি স্কুলের শিক্ষক রমেন পাল (নাম পরিবর্তিত)। শিক্ষক হিসেবে রমেন স্কুলে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন।

Advertisement

রঞ্জন পাল

পূর্ব মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৮:১১
Share:

প্রতীকী ছবি।

নীতির ঘরে দুর্নীতির বাসা। তাতেই কি টোল খাচ্ছে শিক্ষক-ছাত্র-অভিভাবকের শৃঙ্খল!

Advertisement

কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে ২০১৪-এর প্যানেলের দ্বিতীয় নিয়োগে ২৬৯ জন প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি চলে গিয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরে নিয়োগ বাতিল হয়েছে ৩০ জনের। সেই তালিকায় ছিলেন পাঁশকুড়া একটি স্কুলের শিক্ষক রমেন পাল (নাম পরিবর্তিত)। শিক্ষক হিসেবে রমেন স্কুলে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। স্কুলে গেলেই ছাত্রছাত্রীরা ছেঁকে ধরত রমেনকে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, গান, আবৃত্তিও শেখাতেন। হাই কোর্টের নির্দেশে চাকরি যাওয়ার পর আর স্কুলমুখো হননি তিনি। স্কুলে তাদের প্রিয় শিক্ষককে দেখতে না পেয়ে মনমরা ছাত্র ছাত্রীরা। ‘‘স্যার কেন আর স্কুলে আসবেন না?’’ প্ৰধান শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করে কচিকাঁচারা। নির্বাক প্রধান শিক্ষক।

‘‘ছাত্রছাত্রীদের কাছে মাথাটা হেঁট হয়ে যাচ্ছে, বুঝলেন।’’, ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বিষণ্ণতা ঝরে পড়ছিল গড়বেতার এক গৃহশিক্ষকের গলায়। কেন? প্রশ্ন শুনে ওই গৃহশিক্ষক বললেন, ‘‘শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির কথা এখন মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের কাছেও অজানা নয়। পড়তে বসে তাঁরা এ নিয়ে আলোচনাও করে। একদিন তো নবম শ্রেণির এক ছাত্র আমাকে সরাসরিই পরামর্শ দিয়ে বসল, স্যার, উপরে লাইন করতে পারলে আপনার এসএসসি বাঁধা। বুঝুন, ওদের কাছে আমাদের মাথাটা কীভাবে হেঁট হচ্ছে।’’

Advertisement

মেদিনীপুরের এক স্কুলের শিক্ষক বলছিলেন, ‘‘সেদিন ক্লাস নিতে গিয়ে দেখি, কয়েকজন ছাত্র গল্পে ব্যস্ত। গল্পের বিষয় পার্থ- অর্পিতা। ভাবা যায়!’’ তাঁর কথায়, ‘‘ছাত্ররা সরাসরি কিছু বলে না। তবে বুঝতে পারি, ওরাও কয়েকজন শিক্ষককে নিয়ে আলোচনা করে। যাঁরা বছর কয়েক আগে যোগদান করেছেন, যাঁরা অন্য স্কুল থেকে বদলি নিয়ে এসেছেন, তাঁদের নিয়ে। ওই ছাত্রদের কেউ অবশ্য নীচু ক্লাসের নয়, সকলেই উঁচু ক্লাসের।’’ মেদিনীপুরের এক গৃহশিক্ষকও বলছিলেন, ‘‘দেখছি টিউশন শুরুর আগে-পরে ছাত্রদের মধ্যে ওই নিয়ে চর্চা হচ্ছে। এক ছাত্রের মুখে ‘অপা’ শুনে তাকে বকলামও কয়েকদিন আগে। আগে কখনও শিক্ষকদের নিয়ে এমন নেতিবাচক চর্চা ছাত্রদের করতে দেখিনি।’’ ঝাড়গ্রাম জেলার বিনপুর এলাকার এক অভিভাবক বলছেন, ‘‘এখন চারিদিকে শুধু শিক্ষকদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বাচ্চারা সেইসব শুনছে। টেলিভিশনে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে দুর্নীতি নিয়ে সব সময় দেখাচ্ছে। তা হলে নবপ্রজন্মের শিক্ষকদের সম্পর্কে বাচ্চাদের মনে প্রভাব পড়বেই।’’ চন্দ্রকোনা রোডের বাসিন্দা পেশায় ব্যাঙ্ক কর্মী এক অভিভাবক অবশ্য এখনও বিশ্বাস করেন, ‘‘মুষ্টিমেয় কয়েকজনের অপকর্মের জন্য পুরো শিক্ষক সমাজ বা শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে প্রশ্ন তোলা ঠিক নয়। এখনও অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন যাঁরা পথ দেখায় সমাজকে।’’

সহপাঠীদের কৌতুহলী কথার সামনে পড়তে হচ্ছে শিক্ষক দম্পতির সন্তানদেরও। পাঁশকুড়ার একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে রিয়াঙ্কা(পরিবর্তিত)। রিয়াঙ্কার বাবা,মা দু’জনেই শিক্ষক। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি সামনে আসার পর রিয়াঙ্কাকে অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছে, ‘‘তোর বাবা-মায়ের চাকরিটা আসল না নকল?’’ ছোট্ট রিয়াঙ্কা এখনও বুঝে উঠতেই পারেনি কেন তাকে এ সব কথা শুনতে হচ্ছে! গড়বেতার একটি স্কুলের শিক্ষক বললেন, ‘‘ছেলে স্কুলে বন্ধুদের কাছ থেকে শুনে এসে নানা প্রশ্ন করে আমাদের কাছে জানতে চায়। আমরা বুঝিয়ে বললেও, শিক্ষায় নিয়োগ ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁদের কৌতুহল মেটে না। চাপও তাদেরও।’’

ঝাড়গ্রাম শহরের নবম শ্রেণির এক ছাত্র কৃশানু রায় (নাম পরিবর্তিত) ইংরেজি পড়তে গিয়েছেন কয়েকদিন আগেই। ওই ছাত্রের বাবা-মা দু’জনেই শিক্ষক। সেখানে গৃহশিক্ষক আসার আগেই কোটি কোটি টাকা উদ্ধার নিয়ে আলোচনা চলছিল। পড়তে আসা এক ছাত্রী কৃশানুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এ ভাবে টাকা দিয়েই কি শিক্ষকরা চাকরি পান। কৃশানু অবশ্য কোনও উত্তর দিতে পারেনি। মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছে শিক্ষকদের নিয়ে কটু কথা। পরে কৃশানু বলছে, ‘‘বাড়ি এসে বাবাকে কথা জানিয়েছিলাম। ওই সময় খুবই কষ্ট হচ্ছিল। নিজের প্রতি রাগ হচ্ছিল। কিন্তু বাড়িতে বাবা বোঝানোর পর বুঝলাম সব শিক্ষক সমান নন।’’

ছাত্রধারা বয়ে চলে যায়। লিখেছিলেন কবি কালিদাস রায়। তিনি কি কখনও ভেবেছিলেন রাজনীতি বিষ মেশাবে সে ধারায়।

(সহ প্রতিবেদন: রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য, রঞ্জন পাল, বরুণ দে)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement