প্রতীকী চিত্র।
মাদকের মায়াজাল ছড়াচ্ছে অরণ্যশহরে। সে জালে আটকে ছটফট করছে কৈশোর-যৌবন। পুলিশ দেখছে। মাঝে মাঝে ব্যবস্থাও নিচ্ছে। কিন্তু এ জাল সমূলে উপডে ফেলতে যে আন্তরিকতা দরকার, কোথাও যেন তার অভাব থেকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন অভিভাবকদের একাংশ।
ব্রাউন সুগার। নিষিদ্ধ এই মাদকের ব্যবসা বহুদিন ধরেই চলছে ঝাড়গ্রাম শহরে। মোবাইলের ব্যাটারির বদলে সেখানে রেখে দেওয়া হচ্ছে মাদকের প্যাকেট। অনেক সময় মোবাইল কভারের পিছনে লুকিয়ে মাদক চালান হচ্ছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা। স্কুল ও কলেজ পড়ুয়ারা এই নেশার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছেন। শুক্রবার খদ্দের সেজে হাতে-নাতে ঝাড়গ্রাম শহরে ব্রাউন সুগার কারবারি সোনালি বিশাল ওরফে পিঙ্কি নামে এক মহিলাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ধৃতের বাড়ি ঝাড়গ্রাম শহরের বিবেকানন্দ পল্লি এলাকায়। তার কাছ থেকে ১৯ গ্রাম ব্রাউন সুগার উদ্ধার করেছে পুলিশ। পিঙ্কি তার বাড়িতেই কারবার চালাত বলে অভিযোগ। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত চক্রের হদিস পেতে পিঙ্কিকে হেফাজতে নিয়েছিল পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে কিছু সূত্রও মিলেছে বলে দাবি তদন্তকারীদের। আপাতত পিঙ্কি রয়েছে জেল হেফাজতে।
শুধু বিবেকানন্দপল্লি এলাকায় নয় ঝাড়গ্রাম শহরের শক্তিনগর, ফণির মোড়, নৃপেনপল্লি, উত্তর বামদা, নামো জামদা, কাঞ্চনওয়েল মিলের আশেপাশে একাধিক জায়গায় এই চক্র চলছে বলে অভিযোগ। এসব এলাকা ছাড়াও আনাচে কানাচে শহরে এই চক্র বেড়ে উঠেছে। অনেকে ‘টাকার লোভে’ এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে কম বয়সী মহিলাদের দিয়ে পাচারের কাজ করায় মাদক ব্যবসায়ীরা। এর আগে শহরে এই নেশায় আসক্ত হয়ে বাইক দুর্ঘটনা ও আবাসন থেকে ঝাঁপ দিয়ে একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশ সূত্রের খবর, মাদক জাল ছড়িয়ে আছে ওড়িশার জলেশ্বর-বারিপাদা এলাকা পর্যন্ত। পুলিশের দাবি, ব্রাউন সুগার মূলত উত্তরবঙ্গ ও ওড়িশা দিয়ে ঢোকে। এ জেলায় ওড়িশার যোগ বেশি রয়েছে। পুলিশ সুপার বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘‘ওড়িশা সীমানা দিয়েই ঢোকার সম্ভাবনা বেশি। এ জেলায় অনেকটা ওড়িশা সীমানা রয়েছে। একজন ধরা পড়ার পর এখন অনেকে অ্যালার্ট হয়েছে। তবে নিয়মিত অভিযান চলছে। কারা এই চক্রে সঙ্গে যুক্ত রয়েছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।’’ মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মুস্তাকিম রহমান জানান, হেরোইনের একটি ভাগ হল ব্রাউন সুগার। ব্রাউন সুগার ব্যবহারের ফলে কেউ প্রথমে আনন্দ পায়। প্রথমে অভ্যাস ও নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ব্রাউন সুগার দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে রোগা হয়ে যায়। স্বভাবগত পরিবর্তন ঘটে। টানা ব্যবহার করলে কোমায় চলে যেতে পারে। দুর্ঘটনায় মৃত্যু পর্যন্ত হয়।
সবচেয়ে অসহায় অবস্থা অভিভাবকদের। কারণ, ৯৯ শতাংশ অভিভাবকদের ব্রাউন সুগার সম্পর্কে ধারণা নেই। যার ফলে ধরাও খুব মুশকিল। কারণ, মদ, সিগারেট খেলে মুখ থেকে গন্ধ বের হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হয় না। অভিভাবকেরা যখন বুঝতে পারেন বহু ক্ষেত্রে দেখা যায় তাঁদের সন্তান মাদকের জালে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়েছে। শহরের এক অধ্যাপক বলেন, ‘‘শহরের স্কুল পড়ুয়া থেকে যুব সমাজ এই নেশার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে। কয়েক বছরে রমরমা এই ব্যবসা বেড়ে উঠেছে। পুলিশের উচিত তদন্ত করে এই চক্রের মাথাকে খুঁজে বের করা।’’
তা হলে উপায়? ঝাড়গ্রামের ‘মনোবিদ’ দীপঙ্কর পাল জানাচ্ছেন, অভিভাবকদের সজাগ হতেই হবে। সন্তানের আচার, আচরণে সন্দেহ হলে সব কিছু খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কথা বলতে হবে সন্তানের সঙ্গে। গডে তুলতে হবে নিবিড় যোগাযোগ। বোঝাতে হবে মাদকের কুফল। প্রয়োজনে পেশাদারদের সাহায্য নিতে হবে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করলে মাদকের নেশা থেকে মুক্তি সম্ভব।
আর সমাজকে মাদক মুক্ত করতে গেলে কড়া চিকিৎসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে পুলিশকে।