অনেক সময় দর্শকেরাও ঘিরে ধরেন শিল্পীকে। ফাইল চিত্র
জলসা মঞ্চে দেখা যাবে তারকা শিল্পীদের। সেই টানে অনুষ্ঠানে ভিড় করেন আমজনতা। তাঁদের ‘আবদার’ মেটাতে অনেক সময় নির্দিষ্ট সময়ের পরেও মঞ্চ মাতিয়ে রাখেন শিল্পীরা। কিন্তু ওই অনুষ্ঠানে যথাযথ পরিকাঠামো রয়েছে কি না বা শিল্পীদের সুরক্ষাই কতটা থাকে, বলিউডের সঙ্গীত শিল্পী কৃষ্ণকুমার কুন্নথ ওরফে কে কে-র মৃত্যুর পর সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
কলকাতার নজরুল মঞ্চে কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মঙ্গলবার গান গাইতে এসেছিলেন কে কে। অনুষ্ঠান চলাকালীনই সাময়িক অসুস্থ হয়েছিলেন কে কে। হোটেল ফিরে ফের অসুস্থ হন। পরে তিনি মারা যান। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েই শিল্পীর মৃত্যু হয়েছিল বলে মনে করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে উঠে এসেছে অনুষ্ঠান আয়োজনে একাধিক অনিয়মের তথ্য। প্রেক্ষাগৃহটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলেও অতিরিক্ত দর্শক হাজির হওয়ায় সেখানের পরিবেশ খুবই অসহনীয় হয়ে গিয়েছিল।
বর্ষার মরসুমের কয়েকটা মাস বাদ দিলে সারা বছরই পূর্ব মেদিনীপুরে বিভিন্ন পুজো, উৎসব উপলক্ষে নানা ধরনের জলসা অনুষ্ঠিত হয়। মূলত চার ধরনের অনুষ্ঠান বেশি হয়ে থাকে জেলায়— বড় শিল্পীদের নিয়ে অর্কেস্ট্রা ব্যান্ড এবং বিচিত্রানুষ্ঠান, নাচের অনুষ্ঠান (যা স্থানীয় ভাষায় 'ডান্সট্রুপ' নামে পরিচিত), যাত্রাপালা, লোক সঙ্গীত ও বাংলা ব্যান্ডের অনুষ্ঠান। কে কে'র মৃত্যুর ঘটনায় ওই সব অনুষ্ঠান আয়োজনের একাধিক অব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। স্থানীয় সূত্রের খবর, মুক্ত মঞ্চের অনুষ্ঠানে দর্শক টানতে এখন হামেশাই ছোট বা বড় পর্দার অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে শুরু করে কলকাতা ও মুম্বইয়ের নামকরা সঙ্গীত শিল্পীদের নিয়ে আসেন উদ্যোক্তারা। তারকাদের দেখতে উপচে পড়ে ভিড়।
অভিযোগ, অধিকাংশ জায়গাতেই আয়োজকদের নানা অব্যস্থার শিকার হতে হয় শিল্পীদের। জেলায় অনুষ্ঠান করতে আসা শিল্পীদের একাংশের অভিযোগ, উদ্যোক্তারা অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত দর্শক ধরে রাখতে তারকা শিল্পীদের নির্দিষ্ট সময়ে মঞ্চ দেন না। ততক্ষণ স্থানীয় শিল্পীদের সঙ্গে গ্রিনরুমের ছোট্ট পরিসরে থাকতে হয় শিল্পীদের। গরম কালে কিছু কিছু গ্রিনরুমে ফ্যানের ব্যবস্থা থাকলেও অধিকাংশ জলসা মঞ্চে শিল্পী বা বাদ্যযন্ত্রীদের জন্য ফ্যানের ব্যবস্থা থাকে না বলেও অভিযোগ। এ দিকে, জলসার অনুষ্ঠানগুলি সাধারণত তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টার জন্য বুকিং করা হলেও উদ্যোক্তা আর দর্শকদের আবদার মেটাতে তা পাঁচ-ছ’ঘণ্টা পর্যন্তও অনুষ্ঠান করতে হয়।
কে কে'র মৃত্যুর পর উদ্যোক্তাদের অনুষ্ঠান আয়োজন করার ব্যাপারে আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন অভিনেত্রী পাপিয়া অধিকারী। তিনি বলেন, ‘‘অনেক জায়গায় গ্রিনরুম প্রস্তুত না থাকার কারণে দীর্ঘক্ষণ গাড়িতেই অপেক্ষা করতে হয়। অনুষ্ঠানের মাঝে অন্তত এক দু'বার শিল্পীদের বিরতি দেওয়া উচিত। কিন্তু তা হয় না। সব জায়গায় তো আর মঞ্চ থেকে দূরে ব্যারিকেড করা থাকে না। তাই অতি উৎসাহী দর্শকরা মঞ্চকে যেন ছেঁকে ধরেন। তাঁদের আবদার মেটাতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়তে হয় শিল্পীদের। সে সময় ঘাড়ে ও কানের নীচে আইস ব্যাগ চেপে ধরলে স্বস্তি পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রিনরুমে বরফের কোনও ব্যবস্থা থাকে না। থাকে না কোনও মেডিক্যাল দলও। কে কে-র মৃত্যুর পর এ সমস্ত বিষয় নিয়ে আয়োজকদেরভাবতে বলব।’’
১৮ বছর অর্কেস্ট্রা ব্যান্ডে কী-বোর্ড বাজাচ্ছেন মেচেদার বিপ্লব ঘড়া। অভিনেতা গোবিন্দা, মিঠুন চক্রবর্তী, অভিনেত্রী আমিশা প্যাটেলের মতো শিল্পীদের সঙ্গে মঞ্চে থেকেছেন তিনি। বিপ্লবের কথায়, ‘‘যত দিন যাচ্ছে মুক্ত মঞ্চের অনুষ্ঠানের শৃঙ্খলা ও সুরক্ষাবিধি শিথিল যাচ্ছে। তারকাদের অনুষ্ঠান শেষের পরও আমাদের দিয়ে উদ্যোক্তারা অতিরিক্ত সময় অনুষ্ঠান করান। মদ্যপদের দাপাদাপি শুরু হয় শেষ বেলায়। আয়োজক ও দর্শকদের আরও মানবিক হওয়া দরকার।’’
যদিও ‘ভিড়’ বিষয়টিকে শিল্পীর জীবনের একটা ‘পাওয়া’ বলে মনে করেন সঙ্গীতশিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তী। তিনি বলছেন, ‘‘মৃত্যু নিশ্চয়ই দুঃখের, কিন্তু দর্শক সংখ্যাটাও শিল্পীর কাছে স্বর্গপ্রাপ্তির মতো। গত ৩০ বছর ধরে আমিও চেয়েছি, ভরা দর্শকের সামনে গাওয়ার সময়ই যেন মৃত্যু সামনে এসে দাঁড়ায়। কে কে যেন আমার মৃত্যুটা ছোঁ মেরে নিয়ে চলে গেল।’’
কোনও বড় জলসা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে কী ধরনের পরিকাঠামো থাকা দরকার?
পুলিশ সূত্রের খবর, তাদের অনুমতি নেওয়ার পাশাপাশি, অনুষ্ঠান মঞ্চে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা, অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবার মতো জরুরি পরিষেবাগুলি রাখা আবশ্যিক। তা না হলে, গভীর রাতে কোনও শিল্পী অসুস্থ হলে তাঁকে দ্রুত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পৌঁছে দিতে অসুবিধায় পড়তে হবে আয়োজকদেরই। এ বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার অমরনাথ কে বলেন, ‘‘বড় অনুষ্ঠানের অনুমতি পেতে সমস্ত ধরনের জরুরি পরিষেবা রাখতে হয়। তার মধ্যে রয়েছে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা, চিকিৎসক দল। ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশি রাখা উচিৎ। অনুষ্ঠানের সময়সীমা কতক্ষণ, তার উপরেও বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ হয়।’’
নোনাকুড়ি বাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির আয়োজিত অনুষ্ঠান এলাকায় জনপ্রিয়। ছোট পর্দার বহু তারকা তাতে আসেন।
কে কে মৃত্যু থেকে কি আয়োজকেরা শিক্ষা নেবেন?
ওই দুর্গোৎসব কমিটির কোষাধ্যক্ষ দিলীপ আদক বলছেন, ‘‘আমাদের অনুষ্ঠান মঞ্চের পাশে আশা কর্মীরা থাকেন। সামনেই হাসপাতাল রয়েছে। অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থাও থাকে। তবে এটা ঠিকই যে মফস্বলের অনুষ্ঠান মঞ্চগুলিতে সব ধরনের আয়োজন থাকে না বললেই চলে। এবার সবাইকে শিল্পী স্বাছন্দ্যের বিষয়টি নিয়ে আরও বেশি করে ভাবতে হবে।’’