খেরওয়াল সরেনকে সংবর্ধনা জানাচ্ছেন ঝাড়গ্রাম সাধু রামচাঁদ মুর্মু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অমিয়কুমার পণ্ডা। প্রজাতন্ত্র দিবসে। নিজস্ব চিত্র।
একাদশ শ্রেণির ছাত্রটি লিখেছিলেন একটি যাত্রাপালা, ‘নিধানদশা’। পালার বিষয়বস্তু ছিল আদিবাসী সমাজের একাংশের শিক্ষা ও চেতনার অভাবে করুণ পরিণতি।
‘খেরওয়াল’ শব্দটি সম্মিলিত সাঁওতাল জনগোষ্ঠীকে বোঝায়।
‘‘দু’বার সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার কিংবা এবার ‘পদ্মশ্রী’ পাওয়ায় আমার কোনও কৃতিত্ব নেই। ৪৫ বছর ধরে যে সমাজের কথা লিখে চলেছি, আমার সেই সব সাঁওতাল মা-ভাই-বোনেদের ভালবাসার জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে।’’— সম্মান প্রাপ্তির পরে বলছিলেন কালীপদ সরেন। যিনি সাহিত্য জগতে খেরওয়াল সরেন নামেই পরিচিত। এই ছদ্মনামেই লেখেন।
নিজের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশ করেছেন ছোট থেকে। তারই ফলশ্রুতিতে কালীপদ বা খেরওয়াল সরেন এ রাজ্যে সাঁওতালি সাহিত্যে প্রথম ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান পেতে চলেছেন। বছর চৌষট্টির খেরওয়ালের বাড়ি ঝাড়গ্রাম শহরের ভরতপুরে। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী। সাহিত্যচর্চার জন্য ৩৩ বছরের চাকরি জীবনে পদোন্নতি নেননি। ২০০৭ সালে ‘চেৎরে চিকায়েনা’ নাটকের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান তিনি। ২০১৯ সালে সাঁওতালিতে সেরা অনুবাদ-কাজের জন্য দ্বিতীয়বার সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান। দিব্যেন্দু পালিতের উপন্যাস ‘অনুভব’ সাঁওতালিতে অনুবাদ করেছিলেন।
খেরওয়ালের জন্ম ১৯৫৭ সালের ৯ ডিসেম্বর। লালগড়ের বেলাটিকরি অঞ্চলের রঘুনাথপুর গ্রামে। গ্রামে কোনও স্কুল ছিল না। বেশ কিছুটা পথ হেঁটে গোপালপুর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে যেতে হত। প্রাথমিকের পাঠ চুকিয়ে মেদিনীপুর সদর ব্লকের চাঁদড়া হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ওই স্কুল থেকেই ১৯৭৭ সালে (নবম-একাদশ) হায়ার সেকেন্ডারি উত্তীর্ণ। জামবনি ব্লকের সেবাভারতী মহাবিদ্যালয় থেকে কলা বিভাগের স্নাতক। পরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতকোত্তর হন। ১৯৮৪ সালে স্টেট ব্যাঙ্কের চাকরিতে যোগ দেন। অবসর নেন ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে।
স্কুল জীবন থেকেই তাঁর লেখালিখি শুরু। চাঁদড়া স্কুলের একাদশ শ্রেণিতে লিখেছিলেন যাত্রাপালা ‘নিধানদশা’। কলেজ জীবনে ১৯৭৭ সাল থেকে লেখালেখিতে মগ্ন হওয়া। লিখতে শুরু করেন গল্প, কবিতা, একাঙ্ক নাটক, প্রবন্ধ। ‘পছিম বাংলা’-সহ রাজ্যের বিভিন্ন সাঁওতালি পত্রিকায় তাঁর বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় ‘খেরওয়ালকো দিশাকাতে’। তাঁর প্রথম গল্প সংকলন। ২০০৪ সালে একশোটি কবিতার সংকলন ‘খেরওয়াল আড়াং’। ওই সময়েই প্রকাশিত হয় তাঁর রম্যগ্রন্থ ‘সারিস্যে নাস্যে বেঁগাড় রাস্যে’ (সত্যি না মিথ্যে বেগুনের ঝোল)। তাঁর লেখা ১০০টি সাঁওতালি গান নিয়ে প্রকাশিত ‘সেরেঞ আখড়ারে খেরওয়াল’। এ পর্যন্ত গল্প-কবিতা-নাটক-যাত্রা মিলিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৩টি। নিজে গান লিখে সুর দেন। তাঁর গাওয়া ৪০টি গানের চারটি অডিয়ো সিডি প্রকাশিত হয়েছে। খেরওয়ালের একটি আদিবাসী যাত্রাদলও আছে। ২০১৫ সালে ঝাড়খণ্ডে একটি সাঁওতালি সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন।
প্রথম দিকে বাংলা হরফে সাঁওতালি লিখলেও পরে অলচিকি লিপিতে লেখা শুরু করেন খেরওয়াল। ২০০৪ সালে অল ইন্ডিয়া সান্তালি রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন খেরওয়ালকে পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু পুরস্কারে সম্মানিত করেছে। ২০০৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল সান্তাল কাউন্সিল থেকে পেয়েছেন সেরা সাহিত্যিকের স্বীকৃতি। অল ইন্ডিয়া সান্তালি ফিল্ম অ্যাসোসিয়েশন ২০১৫ সালে তাঁকে সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ দিয়েছে। সাহিত্যে অবদানের জন্য রাজ্যেও সরকারি পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘সারদাপ্রসাদ কিস্কু স্মৃতি পুরস্কার’ ও ২০১৫ সালে ‘সাধু রামচাঁদ মুর্মু স্মৃতি পুরস্কার’এ সম্মানিত হয়েছেন খেরওয়াল।
বৃহস্পতিবার খেরওয়াল বলেন, ‘‘দায়িত্ব বেড়ে গেল। জঙ্গলমহলের আমাদের সমাজের কথা আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাই সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে।’’