ঝাড়গ্রাম জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর আয়োজিত মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠান। নিজস্ব চিত্র
জঙ্গলমহলের আদিবাসী-মূলবাসীদের ভাষার অধিকার কি আদৌ সুনিশ্চিত? আরও একটা ভাষা দিবসে এমনই প্রশ্ন তুলছেন জঙ্গলমহলের আদিবাসী-মূলবাসী বিদ্বজ্জনরা।
২০০৩ সালে সাঁওতালি ভাষা সংবিধানের অষ্টম তফসিলে স্থান পায়। এ রাজ্যের স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে সাঁওতালি ভাষায় পঠনপাঠন হচ্ছে। কিন্তু সাঁওতালি ভাষায় অলচিকি লিপিতে পঠনপাঠনের পরিকাঠামো নিয়েও সন্তুষ্ট নন আদিবাসী বিদ্বজ্জনদের একাংশ। সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত সাঁওতালি সাহিত্যিক নিরঞ্জন হাঁসদা বলছেন, ‘‘বহু মানুষ ও সংগঠনের দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে সাঁওতালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায় করা গিয়েছে। তবে এখনও এ রাজ্যে সাঁওতালি মাধ্যমে পঠনপাঠনের উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি। কয়েক মাস আগে সাঁওতালি মাধ্যমের ডিএলএড পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়েছিল বাংলায়।’’ সাঁওতালি সাহিত্যের প্রসারে সরকারি স্তরে আরও প্রচার ও প্রসার জরুরি বলে মনে করেন নিরঞ্জন।
আদিবাসী জনগোষ্ঠীভুক্ত মুন্ডাদের ‘মুন্ডারি’ ভাষা ও ভূমিজদের ভূমিজ ভাষাকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। নয়ের দশকে ওড়িশার শিক্ষাব্রতী রুইদাস সিংনাগ ‘মুন্ডারি বাণী’ নামে লিপি তৈরি করেন। ভারত মুন্ডা সমাজের উদ্যোগে ঝাড়গ্রাম জেলায় ১৫টি বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলে মুন্ডারি ভাষায় পড়ানো হয়। ভারত মুন্ডা সমাজের সম্পাদক (সংগঠন) হিমাংশু সিং বলছেন, ‘‘মুন্ডারিকে রাজ্যের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা ঘোষণার দাবি করা হলেও মানা হয়নি। অথচ জঙ্গলমহলে সাঁওতালদের পরেই মুন্ডারা দ্বিতীয় সংখ্যা গরিষ্ঠ জনজাতি।’’ ভূমিজ ভাষাতেও পঠনপাঠনের দাবি রয়েছে। ভারতীয় আদিবাসী ভূমিজ সমাজের সহ-সভাপতি তপনকুমার সর্দার জানাচ্ছেন, ১৯৮২ সালে ওড়িশার শিক্ষাব্রতী মহেন্দ্রনাথ সর্দার ভূমিজ লিপি ‘অল অনল’ তৈরি করেন। কিন্তু ভূমিজদের জন্য সরকারি স্তরে কোনও স্কুল নেই। সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে এ রাজ্যে ২৫টি ‘অল অনল’ মাধ্যমের স্কুল চলছে। ওই লিপিতে সাহিত্য সৃষ্টিও হয়েছে।
ওবিসি তালিকাভুক্ত কুড়মিরা আবার আদিবাসী তালিকাভুক্তির দাবিতে দীর্ঘ আন্দোলন করছেন। কুড়মালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতিও দাবি করেছেন তাঁরা। তবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কুড়মালিকে রাজ্যের অন্যতম ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে। তারপরেও সরকারি স্তরে কুড়মালি ভাষার প্রসারে কাজ হয়নি বলে অভিযোগ। বেসরকারি উদ্যোগে কুড়মালি চিসই লিপি তৈরি করেছেন ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক জয়ন্ত মাহাতো। ইউনিকোড রোডম্যাপে ঠাঁই পেয়েছে সেই লিপি। জয়ন্ত বলছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কুড়মালি মাধ্যম সরকারি স্কুল চালুর ঘোষণা করেছিলেন। তা কিন্তু হয়নি।’’ তবে অল ইন্ডিয়া কুড়মালি চিসইআ সোসাইটির উদ্যোগে পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম ও পুরুলিয়ায় কিছু বেসরকারি প্রাথমিক কুড়মালি স্কুল চলছে। তার কয়েকটিকে বাংলার শিক্ষা পোর্টালে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও সরকারি সাহায্য মেলেনি।
ঝাড়গ্রামের বর্ষীয়ান সাহিত্যিক ললিতমোহন মাহাতো বাংলা লিপিতেই কুড়মালি সাহিত্যসৃষ্টি করেছেন। তবে তিনি মানছেন, ‘‘নিজস্ব লিপি ছাড়া কখনও ভাষার বিকাশ সম্ভব নয়। রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলির একটি গরিষ্ঠ অংশ কুড়মালি ভাষায় কথা বলেন। অথচ তার সাংবিধানিক অধিকারের বিষয়ে সরকারি স্তরে পদক্ষেপ হচ্ছে না।’’
শুধু জনজাতির নানা ভাষা নয়, ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ডের সুবর্ণরেখার মধ্য অববাহিকা অঞ্চলের মানুষজন আবার সুবর্ণরৈখিক ভাষায় কথা বলেন। সে ভাষাতেও প্রচুর সাহিত্যসৃষ্টি হয়েছে। এই ভাষার গবেষক তথা গোপীবল্লভপুরের সুবর্ণরেখা কলেজের ইতিহাসের বিভাগীয় প্রধান লক্ষীন্দর পালোই জানালেন, সরকারিস্তরে এই ভাষা নিয়েও পদক্ষেপ হয়নি। অথচ ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুর-১, গোপীবল্লভপুর-২, সাঁকরাইল ও নয়াগ্রাম ব্লকের বাসিন্দারা সুবর্ণরৈখিক ভাষাতেই কথা বলেন।
ভাষা দিবসে এই সব জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার সুরক্ষার দাবি উঠছে। দাবি উঠছে, প্রতিশ্রুতিকে সত্যি করার।