স্মৃতির এই প্রতিষ্ঠান আজ ধ্বংসস্তূপ। ছবি: সোহম গুহ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলাচ্ছে মন্দারমণি। কয়েকদিন আগেও মন্দারমণির জনমানবশূন্য সমুদ্র উপকূল আজ পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র। অথচ যার নামে মন্দারমণির প্রথম পরিচিতি, সেই ‘বেঙ্গল সল্ট কোম্পানি’-র কারখানা অবহেলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত। মন্দারমণি থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে দাদনপাত্রবাড়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ঊনবিংশ শতকের ত্রিশের দশকে এই কারখানা গড়ে তোলেন। তবে আজ কিছুরই আর অস্তিত্ব নেই।
সময়টা ১৯৩০ সাল। ব্রিটিশ সরকারের লবণ আইনের প্রতিবাদে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে উত্তাল সারা দেশ। এই আন্দোলনের প্রভাব পড়ে তৎকালীন বাংলার অবিভক্ত মেদিনীপুরেও। জেলার অন্য জায়গার সঙ্গে রামনগরের বাঁকশালঘাট, পিছাবনি এলাকাতেও সত্যাগ্রহ আন্দোলন কার্যত স্বদেশী আন্দোলনের রূপ নেয়। আন্দোলনের জেরে পিছু হঠে ব্রিটিশ সরকার। ইংরেজরা লবণ আইন প্রত্যাহার করে ভারতীয়দেরও সমুদ্র উপকূলে লবণ উৎপাদনের অধিকার দেয়। লবণ তৈরির অধিকার পাওয়ার পরই প্রফুল্লচন্দ্র রায় বাংলাদেশের যুব সমাজকে লবণ তৈরি-সহ ব্যবসায় উৎসাহিত করতে উদ্যোগী হন।
কলকাতার কয়েকজন সম্পন্ন শিক্ষিত যুবককে উৎসাহিত করে ১৯৩৪ সালে প্রফুল্লচন্দ্র রায় মেদিনীপুরের দাদনপাত্রবাড়ে নির্জন সমুদ্র উপকূলে গড়ে তোলেন ‘বেঙ্গল সল্ট কোম্পানি লিমিটেড’। তিনিই কোম্পানির চেয়ারম্যান হন। ম্যানেজিং এজেন্ট হন কলকাতার হাটখোলা দত্ত পরিবারের মনুজেন্দ্র দত্ত। কোম্পানির পরিচালকমণ্ডলীতে ছিলেন যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, এন কে বসু, চারুচন্দ্র বিশ্বাস প্রমুখ। প্রায় ১ হাজার ছ’শো একর জমির উপর বিশালাকৃতির একাধিক ঘেড়িতে নুন মিশ্রিত জল জমিয়ে সূর্যের তাপকে কাজে লাগিয়ে লবণ তৈরির কাজ শুরু হয়। কারখানায় কাজ করতেন বিভিন্ন রাজ্যের প্রায় পাঁচশো শ্রমিক।
১৯৬১ সালে রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় কারখানা পরিদর্শন করেন। লবণ শিল্পের উন্নতির জন্য ফরাসী বিশেষজ্ঞদের নিযুক্তও করেন তিনি। বিশেষজ্ঞদের দেওয়া রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে কোম্পানির ২৩ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় রাজ্য সরকারের শিল্প দফতর। তারপর প্রায় দু’দশক ভাল ভাবেই চলে কারখানাটি। ১৯৮৭ সাল থেকে কারখানাটি ক্রমে রুগ্ন হতে শুরু করে। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই বাড়তে থাকে কারখানার লোকসানের বোঝা। ২০০০ সালে বন্ধ হয়ে যায় কারখানাটি। কারখানার প্রাক্তন কর্মী অনন্ত নায়কের দাবি, “১৯৯০ সাল থেকে কোম্পানির কর্মীদের বেতন, বোনাস, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটি বাবদ এক কোটিরও বেশি টাকা আজও বকেয়া পড়ে রয়েছে।’’ নব্বইয়ের দশকে জীবিকার স্বার্থে কারখানার বঞ্চিত ৬০ জন শ্রমিক পাঁচশো একর জমিতে সমবায়ের মাধ্যমে লবণ উৎপাদনের কাজ শুরু করে। আজও তা চলছে।
কারখানার অনেক শ্রমিক বর্তমানে মারা গিয়েছেন। প্রাপ্য বকেয়া না পেয়ে অনেকে দিনমজুরি করে কষ্টে দিনযাপন করছেন। কারখানার ধ্বংসস্তুপের মধ্যেই আজও বসবাস করছেন আট জন শ্রমিকের পরিবার। ভিন্ রাজ্য থেকে এক সময় কারখানায় কাজ করতে এলেও আর ফিরে যাননি তাঁরা। ওড়িশার বাসিন্দা ভোণ্ডা নায়ক, অন্ধ্রপ্রদেশের বাসিন্দা সিগ্রিওয়ালা আপ্পানা ও সিগ্রিওয়ালা রামলুরা ক্ষোভের সঙ্গে জানান, সারা বছরে প্রায় ২৫ হাজার কিলোগ্রাম লবণ উৎপাদিত হয়। বেঙ্গল সল্ট কোম্পানির জায়গায় বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হওয়ার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
বেঙ্গল সল্ট ছাড়াও কাঁথি মহকুমার সমুদ্র উপকূলে বেসরকারিভাবে প্রায় ৪০টি প্রতিষ্ঠান লবণ উৎপাদন করে থাকে। সরকারি উদাসীনতায় সেই সব প্রতিষ্ঠানগুলিও ধুঁকছে। বেসরকারি লবণ সংস্থাগুলির সংগঠন ‘কন্টাই সল্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি শ্যামল গিরি বলেন, “সরকারি সহযোগিতা ছাড়াই বছরে প্রায় ৪০ হাজার টন লবণ উৎপাদন হয়। তবে বিদ্যুৎ সঙ্কট ও পরিবহণ সমস্যার দরুন উৎপাদনে সমস্যা হয়।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘সম্প্রতি কয়েকজন জোর করে লবণের ঘেড়ি দখল করে মাছ চাষের কাজ করছে। প্রশাসনকে এ বিষয়ে জানিয়েও কাজ হয়নি। সরকার লবণ শিল্পের উন্নয়নে নজর দিলে উৎপাদন আরও বাড়ানো যাবে।’’
দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদ (ডিএসডিএ)-এর চেয়ারম্যান তথা কাঁথির সাংসদ শিশির অধিকারীর বক্তব্য, ‘‘রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বেঙ্গল সল্ট কারখানার সাতশো একর জমিতে ৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাবিশিষ্ট বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী ও সেচ মন্ত্রী এলাকা পরিদর্শনও করে গিয়েছেন।’’ তাঁর কথায়, ‘‘শ্রমিকদের বকেয়া মিটিয়ে দেওয়া নিয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উন্নয়ন সংস্থা বিষয়টি দেখভাল করছে।’’
আজ, মঙ্গলবার প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ৭১ তম প্রয়াণ দিবস। কারখানার একাংশ কর্মীর আশা, এ বার অন্তত লবণ কারখানার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো হোক।