বালি পাচার রুখতে পুলিশি উদ্যোগ। প্রতীকী চিত্র।
নদীর বালি চোখের বালি হয়ে উঠলে ময়দানে নামতে হয় পুলিশকে।
২০ জুন ২০২২। নবান্ন থেকে রাজ্য সরকারের চিফ সেক্রেটারি জারি করলেন নতুন নির্দেশিকা (মেমো নম্বর ২৩২৭ - ১৫/১১৯/২২)। বলা হল, এখন থেকে জমির মিউটেশন, রেকর্ড, এমনকি বালি-পাথর উত্তোলনের মতো কাজ দেখভাল করবে 'ব্লক লেভেল ল্যান্ড সার্ভিস মনিটরিং কমিটি'। যে কমিটি হবে তিনজনের। কমিটির চেয়ারম্যান থাকবেন বিডিও, আহবায়ক বিএলআরও, আর সদস্য হবেন সংশ্লিষ্ট থানার আইসি বা ওসি। ব্লকের অনুরূপ মহকুমাস্তরেও এই কমিটি গড়ে তোলার নির্দেশ ছিল সেই নির্দেশিকায়। ব্লক স্তরের কমিটিকে প্রতি বুধবার, আর মহকুমা স্তরের কমিটিকে মাসে একবার বৈঠক করতেও স্পষ্ট বলে দেওয়া হয় সেই নির্দেশিকায়। জুনের সেই নির্দেশিকা জেনে জুলাইয়ে জেলার এক পুলিশকর্তা বলেছিলেন, ‘‘সব দেখেশুনে মনে হয়, পুলিশের উপরেই রয়েছে এ ভুবনের ভার।’’
বিরোধীদের কটাক্ষ, এ ভুবনের জল, জমিন, আসমান সবই এখন তৃণমূলের মালিকানাধীন। যা নিজের তা নিলে তো আর লুট বলা চলে না। মাঝে মাঝে পরিমিতিবোধের অভাব ঘটলে বিব্রত হতে হয়। আর তখনই সক্রিয় হয় প্রশাসন। জমি, বালি, পাথর রক্ষায় পথে নামে পুলিশ। বিরোধীদের এ-ও কটাক্ষ, পুলিশের যা কাজ এ ক্ষেত্রেও তাই করে। গৃহস্থকে সতর্ক হতে বলে চোরকে বলে চুরি করতে। তাই দিনের বেলা ধরা পড়ে বহন ক্ষমতার অধিক বালি বোঝাই বালি, পাথর। রাতে পার হয়ে যায়, ছোট গাড়ি। সে সব গাড়ির কতগুলির যে সিএফটি ভিত্তিক ক্যারিং অর্ডার নেই তার হিসেবে কে রাখে! পুলিশের তরফ থেকে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। বিজেপির রাজ্য নেতা তুষার মুখোপাধ্যায় বলেন, "তৃণমূলের ঝাণ্ডাধারী মাফিয়ারাই তো এই বালি কারবার করে, ইন্ধন পায় পুলিশের কাছ থেকেও।’’ তবে তৃণমূলের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কো- অর্ডিনেটর অজিত মাইতি বলেন, ‘‘কোনও বেআইনি কাজকর্ম দল সমর্থন করে না। প্রশ্রয়ও দেয় না।’’
কয়েকমাস আগে ফোনালাপের একটি অডিয়ো (সেই অডিয়োর সত্যতা আনন্দবাজার যাচাই করেনি) সমাজমাধ্যমে ফাঁস হয়েছিল। চন্দ্রকোনা রোডের তৃণমূলের দুই নেতাকর্মীর মধ্যেকার হওয়া ফোনে সেই কথোপকথনের অডিয়োয় দলের এক বড়নেত্রীর প্রসঙ্গ যেমন এসেছিল, তেমনই পুলিশকে পয়সা দেওয়ার কথাও পরোক্ষে এসেছিল।
গড়বেতা, চন্দ্রকোনা, মেদিনীপুর সদর ব্লক, ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুরের দু’টি ব্লক, নয়াগ্রাম, সাঁকরাইল এলাকায় অবৈধ বালি কারবার নতুন কিছু নয়। নানা উপায়ে বালি চুরি চলছেই। এইসব এলাকায় বালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ লেগেই থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ আসে ভূমি দফতর ও পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার। এক বালি মাফিয়ার সাফ কথা, ‘‘ভূমি দফতর তো অভিযান করতে যায়। কিন্তু পুলিশ সঙ্গে না থাকলে বালি চুরি করা যাবে না। পুলিশের ইন্ধন থাকে বলেই তো বালি চুরি হচ্ছে।’’ ব্যাখ্যা দিয়ে ওই বালি কারবারি বলেন, ‘‘স্থানীয় নেতাদের সেখানে পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করে। তার ফলেই গোপনে অনেক বালি চুরি হয়ে যাচ্ছে।’’ নিয়মের বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত বালি নিয়ে গাড়ি যাতায়াতে কারবারিদের নির্ভর করতে হয় উর্দিধারীদের উপরে। যা থেকে অভিযোগ আসে, বালি গাড়ি থেকে পুলিশের তোলা আদায়ের। বালি কারবারে পুলিশ যতটা 'সক্রিয়', মোরাম বা বোল্ডার পাচারে ততটা নয় বলে কারবারিরা বলছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, দুই জেলার অধিকাংশ মোরাম বা বোল্ডার খাদান কার্যত বন্ধই আছে, সেখান থেকে পাচারও কমেছে। ফলে মোরাম বা বোল্ডার পাচারকারীদের সঙ্গে পুলিশের সখ্যতা এখন আর অতটা নেই।
বালিকে অনেকে ঠাট্টা করে বলে পোস্ত। সেই 'পোস্ত' বালি ঘিরে চলে কোটি টাকার তোলাবাজি। বিপুল রাজস্ব হারায় সরকারও। এ নিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশের কাছে অভিযোগ জমা পড়েছিল। অভিযোগ গিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর দফতরেও। অভিযোগে দাবি করা হয়েছিল- ১২ মাসের (২০২০) মধ্যে ৯ মাসেই প্রায় ৮ কোটি টাকার তোলাবাজি করা হয়েছে। গড়বেতার বিভিন্ন খাদান থেকে ২০০-২৫০ লরি বালি যায়, যা থেকে ৯ মাসে ৬ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা তোলা আদায় করা হয়েছে। আরও নানাভাবে ১ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা তোলা আদায় করা হচ্ছে। গড়বেতায় বালি কারবারের কথা অজানা নয় মুখ্যমন্ত্রীর। এনিয়ে বারবার তিনি সতর্ক করেছেন। কিন্তু বন্ধ হয়নি কারবার।
ঝাড়গ্রাম জেলায় নতুন করে বালি তোলার অনুমতি এখনও দেওয়া হয়নি। তা সত্ত্বেও অভিযোগ উঠছে পুলিশের একাংশ যোগসাজশে জেলা জুড়ে বেআইনি বালির কারবার চলছে। ঝাড়গ্রাম ব্লকের চুবকা ও সর্ডিহা অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় কংসাবতী থেকে বালি তোলা হচ্ছে। বড় লরির পরিবর্তে রাতের বেলা ছোট গাড়িতে করে সেই বালি পরিবহণ হয়। লালগড় ব্লক থেকেও কংসাবতীর বালি যথেচ্ছভাবে তোলা হচ্ছে। বহনক্ষমতার চেয়েও অত্যধিক বালিবাহী লরি যাতায়াতের ফলে জেলার অধিকাংশ রাস্তার দফারফা অবস্থা।
যদিও ঝাড়গ্রাম জেলা ভূমি দফতরের এক আধিকারিক বলছেন, ‘‘বেআইনি বালির বিরুদ্ধে নিয়মিত ধরপাকড় করে মামলা রুজু হয়। এখন বেআইনি বালি পরিবহণ বন্ধ রয়েছে। নতুন করে বেআইনি বালি পরিবহণের অভিযোগ নেই।’’ অন্যদিকে, পুলিশের বক্তব্য, বৈধ অনুমতি থাকা বালি গাড়ি গুলি বালি পরিবহণ করছে। বহন ক্ষমতার অতিরিক্ত বালিবাহী গাড়ি ধরা পড়লে পদক্ষেপ করা হয়।
বিরোধী দলের এক নেতা বালি নিয়ে একইসঙ্গে সতর্ক করেছেন তৃণমূল ও পুলিশকে। হাসির ছলেই তিনি বললেন, ‘‘কয়েকদিন আগে জেলার একটি থানায় কালীপুজো উপলক্ষে সমসাময়িক এক ব্যান্ডের গান শুনছিলাম। গানের কথা ছিল খানিকটা এইরকম...আমি আমি জানি জানি চোরাবালি/ কতখানি গিলেছে আমাদের রোজ।’’ (চলবে)
(তথ্য সহায়তায়: কিংশুক গুপ্ত, বরুণ দে, অভিজিৎ চক্রবর্তী, রঞ্জন পাল)