আদালতের রায় শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন সাজাপ্রাপ্ত পরিবারের লোকজন। মেদিনীপুর আদালতে। নিজস্ব চিত্র
বাড়ির পিছনের জমিটা তাঁদের নয় বলে দাবি করে গত আট বছরে বারবার দায় ঝাড়তে চেয়েছিল অভিযুক্তদের পরিবার। তবে শেষ রক্ষা হল না। আদালতের রায় শোনার পরে একযোগে তৃণমূল, পুলিশ ও সিআইডির বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা জানালেন সাজাপ্রাপ্তদের পরিবার। দাবি তুললেই সিবিআই তদন্তেরও। পাল্টা উচ্চ আদালতে গিয়ে সাক্ষী দিতে প্রস্তুত বলে জানালেন গ্রামবাসীরাও।
পিংলার ব্রাক্ষ্মণবাড়ে বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ মামলায় ধৃত রঞ্জন মাইতি, নিমাই মাইতি ও শেখ সুরজকে তিনজনকে সোমবার ১৫ বছর কারাদণ্ডের সাজা শুনিয়েছে মেদিনীপুর আদালত। এই সাজা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকুক, এমনই চাইছেন ব্রাক্ষ্মণবাড়ের বাসিন্দারা। ২০১৫ সালের ৬ মে রাতের বিস্ফোরণে মৃত ১৩ জনের মধ্যে ছিলেন পাশের গ্রাম সুদছড়ার বান্ধার (বাজি কারিগর) রামপদ মাইতি ও তার স্ত্রী। অভিযোগ, রামপদ মাইতিকে সঙ্গী করেই বাড়ির পিছনে ওই কারখানা খুলেছিল এলাকার তৃণমূল নেতা রঞ্জন। সঙ্গে ছিল তাঁর ভাই নিমাই মাইতি। গ্রামবাসীদের দাবি, নামে বাজি কারখানা হলেও তার আড়ালে চলত বোমা তৈরির কারবার। রঞ্জন নিজে ও নিমাইয়ের স্ত্রী সুলেখা তৃণমূলের কর্মী হওয়ায় প্রতিবাদ করেও সুরাহা হয়নি। ওই বাড়িতে তৃণমূল নেতা ও পুলিশের আনাগোনাও ছিল। বিস্ফোরণের পরে অবশ্য ছবিটা বদলে যায়। রঞ্জন, নিমাইদের শাস্তির দাবিতে এককাট্টা ছিল প্রায় গোটা গ্রাম। অবশেষে তাদের সাজা ঘোষণা হল।
এতদিন নিজেকে তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী বলে দাবি করতেন নিমাইয়ের স্ত্রী সুলেখা মাইতি। সোমবার অবশ্য তিনি সেই তৃণমূল, পুলিশ ও সিআইডির বিরুদ্ধেই সরব হয়েছেন। তাঁর দাবি, “ওই বাজি কারখানা ছিল রামপদ মাইতির। তৃণমূলের নেতা, পুলিশ সবাই এসে মাসে-মাসে মোটা টাকা নিয়ে যেত। সিআইডিও আমাদের কাছে ২০ লক্ষ টাকা দাবি করেছিল। দিতে পারিনি। তাই সিআইডি আমার স্বামী ও ভাসুরকে ফাঁসিয়েছে। পরে তৃণমূলের বড় নেতারাও আমাদের দেখেনি। আমরা হাই কোর্টে যাব। সিবিআই তদন্তের দাবি জানাব।”
এই মামলায় বড় জটিলতা তৈরি হয় বাজি কারখানার জমিটি নিয়েই। ওই জমি রঞ্জনরা ব্যবহার করত বলেই সাক্ষ্য দেন গ্রামবাসীরা। সেই সাক্ষীদের মধ্যে রয়েছেন রঞ্জনের ভাইঝির স্বামী গ্রামেরই বাসিন্দা অরিন্দম মাইতিও। তার কথায়, “আমি যা সত্যি তাই আদালতকে জানিয়েছিলাম। ওই জমি রঞ্জন মাইতিরা ব্যবহার করত। আদালত যে রায় দিয়েছে সেটা সঠিক বলেই মনে করি। তবে নিঘটনায় যে তৃণমূল নেতারাও যুক্ত ছিল তাদেরও শাস্তি হওয়া উচিত ছিল।” মাইতি পরিবারের অবশ্য দাবি, কোনও এক আদিবাসী পরিবারের জমিতে ওই বাজি কারখানা চলত। সেই কারখানা চালাত রামপদ মাইতি। সুলেখা বলছিলেন, “আমি সমস্ত কাগজ আদালতে দেখিয়েছি। যে জমিতে বাজি কারখানা ছিল সেটা আমাদের না তা প্রমাণ দিয়েছি। শুধুমাত্র পাশের একটি জমি আমাদের-সহ অনেকের নামে হওয়ায় সেটা দেখিয়েছে সিআইডি। জোর করে অনেককে দিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া করিয়েছে সিআইডি। সেটার উপরে নির্ভর করে বিচারক এই রায় দিয়েছেন।”
এ দিন গ্রামে সাজা ঘোষণার খবর পৌঁছলে গ্রামবাসীদের চোখেমুখে স্বস্তি ধরা পড়েছে। সুলেখা হাই কোর্টে যাওয়ার কথা বলায় পাল্টা সাক্ষী দিতে হাইকোর্টে গ্রামবাসীরাও যাবে বলে জানিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়ের বাসিন্দা নন্দদুলাল হেমব্রম বলেন, “উচিত সাজা দিয়েছে বিচারক। কারদণ্ড আরও বেশি হলেই ভাল হত। আমরা চাইনা ওরা আর গ্রামে ফিরুক। এর পরেও রঞ্জনদের পরিবার হাই কোর্টে গেলে গ্রামবাসীরাও উচ্চ আদালতে গিয়ে পাল্টা সাক্ষী নিশ্চয় দেব।” সুবোধ হেমব্রম, মঙ্গল প্রধানদের মতো আরও কয়েকজন গ্রামবাসীর কথায়, “দোষ করলে শাস্তি তো পেতেই হবে। এই সাজা দৃষ্টান্ত হোক। যাতে আর কেউ এমন সাহস না পায়। আশা করি জেল থেকে ছাড়া পেলে রঞ্জন মাইতিরা শুধরে যাবে। কিন্তু এর পরে ওঁরা উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করলে গ্রামের লোকও সত্যিটা উচ্চ আদালতে বলবে।”