বরাত মতো জিনিস বাক্সবন্দি করতে কর্মীদের সাহায্য করছেন অরিন্দম (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র
অ্যাপের বোতাম টিপলেই মাছ, মাংস, আনাজ পৌঁছে যাচ্ছে গ্রাহকের নির্দিষ্ট ঠিকানায়। অরণ্যশহর ঝাড়গ্রামের শহরে একাধিক সংস্থার উদ্যোগে শুরু হয়েছে অনলাইন এই পরিষেবা। ফলে সীমিত পরিসরে হলেও বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি হোম ডেলিভারি সংস্থাগুলিতে সরাসরি আনাজ বিক্রি করে আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন চাষিরাও। আবার গ্রাহকেরাও সুলভ দামে বাড়িতে বসেই পেয়ে যাচ্ছেন দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রী। গ্রাহকদের একাংশ বলছেন, ঝাড়গ্রামে পরিষেবা চালু হওয়ায় করোনা পরিস্থিতিতে বাজারে যাওয়ার ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে না।
ঝাড়গ্রাম শহরের তিন যুবক অরিন্দম দে, চন্দন বেজ এবং নন্দন বেজ গত মার্চে প্রথম শুরু করেন মাছ, মাংস, ডিম, আনাজ, মুদি, মনোহারি সামগ্রীর হোম ডেলিভারির ব্যবসা। তাঁরা তাঁদের সংস্থার নাম দেন ‘পেপ ব্যাগ’। যার অর্থ পিপল্স ব্যাগ অথবা জনগণের থলি। অরিন্দম পলিটেকনিকের ভোকেশন্যাল কোর্সের চুক্তি ভিক্তিক নোডাল অফিসার। চন্দন বেজ নৃতত্ত্ববিদ্, আদিবাসী লোকসংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করেন। নন্দন স্কুলের শিক্ষক। অরিন্দমের বাড়ি শহরের বাছুরডোবায়। লালগড়ের গুড়ি গ্রামের আদি বাসিন্দা বেজ ভাইয়েরা এখন শহরের ঘোড়াধরার বাসিন্দা। তিনজনেরই ইচ্ছে ছিল অন্য ধরনের কিছু একটা ব্যবসা করার। তখনই জেলা শহর ঝাড়গ্রামে চাকরিজীবীদের বাজার করার সময়ের অভাবের বিষয়টি নজরে আসে তাঁদের। অরিন্দম জানান, তাঁরাও এই সমস্যার ভুক্তভোগী। সকালে বাজারেই অনেকটা সময় কেটে যায়। বাজার করতে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাজকর্মে প্রায়ই দেরি হয়ে যায়। ব্যস! এরপর তিনজনই গত বছর নভেম্বর থেকে লেগে পড়েন ব্যবসায়। একটি বেসরকারি সংস্থার সাহায্য নিয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অ্যাপ তৈরি করে গুগ্ল প্লে-স্টোরে ‘লঞ্চ’ করা হয়।
এরপর মার্চের শেষ থেকে শুরু হয় লকডাউন। ঠিক মোক্ষম সময়ে ২৯ মার্চ থেকে চালু হয় অরিন্দমদের পরিষেবা। ফেসবুক, স্থানীয় এফএম চ্যানেল-সহ বিভিন্ন এলাকায় ফ্লেক্স টাঙিয়ে চলে প্রচার। অরিন্দম এবং চন্দন জানাচ্ছেন, ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে বেশ ঝুঁকিও নিতে হয়েছে। প্রথমেই প্রায় তিন লক্ষ টাকা নিজেদের ট্যাঁক থেকে বিনিয়োগ করেছেন তাঁরা। কম দামে কী ভাবে জিনিসপত্র দিচ্ছেন? চন্দনদের উত্তর, ‘‘বিভিন্ন কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটরের কাছ থেকে পাইকারি দরে এক লপ্তে জিনিসপত্র কেনা হচ্ছে। ফলে লাভ রেখেও খুচরো দরের চেয়ে কিছুটা কম দরে জিনিসপত্র সরবরাহ করতে পারছি।’’ শহরের নুননুনগেড়িয়া এলাকায় একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে সংস্থার ১২০০ বর্গফুটের স্টোর রুম ও অফিস খোলা হয়েছে। কী ভাবে চলছে হোম ডেলিভারি প্রক্রিয়া? অরিন্দমরা জানাচ্ছেন, গ্রাহকেরা সরাসরি অ্যাপের মাধ্যমে জিনিসপত্র অর্ডার করেন। এখনও পর্যন্ত সবই ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’-র মাধ্যমেই চলছে। সম্প্রতি অনলাইন পেমেন্টও চালু করেছেন তাঁরা। অনলাইন অর্ডার দেখে সংস্থার ছ’জন ডেলিভারি বয় জিনিসপত্র বিভিন্ন ব্যাগে গুছিয়ে দেন। এরপর মোটরবাইকে অথবা টোটোয় চাপিয়ে সেই সব জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়া হয় গ্রাহকের ঠিকানায়।
চন্দনদের দাবি, করোনা-কালে উপযুক্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনেই জিনিসপত্র এবং আনাজ প্যাকিং ও ডেলিভারি করা হচ্ছে। বর্তমানে সংস্থার নথিভুক্ত গ্রাহকের সংস্থা প্রায় হাজার দেড়েক। তবে ডেলিভারি-কর্মী সংখ্যা মাত্র ছ’জন হওয়ায় প্রতিদিন ১০০ জনের বেশি গ্রাহককে পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। মুদি সামগ্রী, প্রসাধন সামগ্রী, বেবি ফুড, কাঁচা আনাজ, ফল, মাছ, মাংস, ডিমের মতো দৈনন্দিন প্রয়োজনের সব কিছুই অরিন্দমরা সরবরাহ করছেন। প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে জিনিসপত্র পৌঁছনোর কাজ করা হয়। চন্দনের কথায়— ‘‘মাছ, মাংস, ডিম স্থানীয় ভাবে পাইকারি দরে কিনে নেওয়া হচ্ছে। আগে শহরের পাইকারি বাজার থেকে আনাজ কেনা হত। এখন অবশ্য সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে আনাজ কেনা হচ্ছে। তাই গ্রাহকদেরও টাটকা আনাজ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।’’ চাষিরা আড়তে যে দরে আনাজ বিক্রি করেন, তার চেয়ে আট শতাংশ বেশি দামে আনাজ কিনছেন অরিন্দমরা। ফলে চাষিরাও উপকৃত হচ্ছেন। প্রতিটি ডেলিভারির চার্জ বাবদ গ্রাহকদের থেকে নেওয়া হয় ১২ টাকা।
এই পরিষেবা চালু হওয়ায় শহরের প্রবীণ বাসিন্দাদের খুবই সুবিধা হয়েছে বলে দাবি চন্দনদের। শহরের রঘুনাথপুরের বাসিন্দা লিপিকা চক্রবর্তী ও দেবব্রত চক্রবর্তীর দুই ছেলেই কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন। সত্তরোর্ধ্ব দেবব্রতবাবু নিজে হাতে প্রতিদিন বাজার করতে ভালবাসতেন। কিন্তু করোনা-কালে বাজারে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। অগত্যা এখন ভরসা অরিন্দম-চন্দনদের সংস্থা। লিপিকা চক্রবর্তীর কথা, ‘‘বাড়িতে বসেই সব পেয়ে যাচ্ছি।’’ অরিন্দম জানাচ্ছেন, পুজোর সময় তাঁরা ‘রেডি মেড ফুড’ পরিষেবাও চালু করা করতে চলেছেন। অর্ডার করলেই ঝাড়গ্রাম শহরের বিভিন্ন রেস্তরাঁর খাবার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হবে। ভবিষ্যতে নিজস্ব হোম ডেলিভারি রেস্তরাঁ চালুরও ভাবনা রয়েছে চন্দনদের। ব্যবসার তিন অংশীদার জানাচ্ছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিদিন এক হাজার গ্রাহকের ঠিকানায় জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছেন তাঁরা। এ জন্য আরও ৩০ জন ডেলিভারি বয় নেওয়া হবে। অরিন্দম এবং চন্দনের কথায়, ‘‘যদি ব্যবসাটা ভাল ভাবে দাঁড় করাতে পারি, তা হলে স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে।’’ জেলার গ্রামীণ এলাকাতেও পরিষেবা দেওয়ার পদক্ষেপ করছেন চন্দনেরা।
আবার ঝাড়গ্রাম শহরের বাছুরডোবার পাপিয়া সাহা আরও দুই যুবকের সহযোগিতায় একই ধরনের হোম ডেলিভারির ব্যবসা শুরু করেছেন। তাঁদের সংস্থার নাম ‘মাই বিগ ব্যাগ’। জুনের ১ তারিখ থেকে পরিষেবা শুরু করেছেন পাপিয়ারা। এখানেও অনলাইন অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহকেরা অর্ডার করেন। তবে পাপিয়াদের সংস্থাটি ৬০-এর বেশি বয়সের গ্রাহকদের থেকে কোনও ডেলিভারি চার্জ নেয় না। এখন সংস্থার নথিভুক্ত গ্রাহকের সংখ্যা ৪০০ জন। প্রতিদিন এখন ১৫-২০ জনের ঠিকানায় জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়া হয়। পাপিয়ারাও মাছ মাংস, আনাজ, মুদি সামগ্রী, প্রসাধন সামগ্রী-সহ দৈনন্দিন প্রয়োজনের সব কিছুই সরবরাহ করেন। অন্য দিক, শহরের আদর্শ বেরা ও তাপস পৈড়া মিলে গত মে মাসে শুরু করেন ‘ফার্মিং ফ্রেশ’ নামে হোম ডেলিভারি। তাপস আগে সেল্সের কাজ করতেন। তাপসের আদিবাড়ি গোপীবল্লভপুরে। তবে গত ছ’বছর ধরে তিনি অরণ্যশহরের বাসিন্দা। তাঁদের সংস্থাটিও অ্যাপের মাধ্যমে হোম ডেলিভারি দিয়ে থাকেন। প্রতিদিন গড়ে ৩০ জনের ঠিকানায় সামগ্রী পৌঁছে দেন তাঁরা। তবে মাছ ও মাংস এখনও সরবরাহ করা হচ্ছে না। তাপস জানালেন, সেপ্টেম্বর থেকে মাছ, মাংসও ডেলিভারি শুরু করবেন তাঁরা।