শুরুর ধারা শেষ পর্যন্ত বহাল থাকার লড়াই হয়তো এটাই।
শুরুটা হয়েছিল ২০০৭-এ। নন্দীগ্রামে কৃষি জমি রক্ষার আন্দোলনের জেরে রাজনৈতিকভাবে তৃণমূল প্রথম ফসল ঘরে তুলেছিল পাঁশকুড়াতে। ওই বছরের জুন মাসে পুর নির্বাচনে পুরবোর্ড দখল করেছিল তৃণমূল। একদা বামেদের শক্ত ঘাঁটিতে সেই ঘাসফুল ফোটার শুরু।
সেই পাঁশকুড়া, যেখানকার কৃষি জমিতে চাষিরা শুধু ধান, ফুল নয় নানা ধরনের সব্জি ফলান সারা বছর ধরে। সেই কৃষি প্রধান পাঁশকুড়ায় স্টেশন সংলগ্ন সব্জি বাজার সারা রাজ্যের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। কিন্তু এমন বাজারে ন্যূনতম পরিষেবার কোনও ব্যবস্থা নেই বলে অভিযোগ।
রাজ্যে পালাবদলের পর মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী নন্দীগ্রামের পাশাপাশি পাঁশকুড়া স্টেশনের কিছু দূরে নতুন কৃষক বাজার তৈরি করা হয়েছে কয়েক কোটি টাকা খরচে। গত বছর আনুষ্ঠানিকভাবে ওই কৃষি বাজারের উদ্বোধনও হয়েছে। কিন্তু সেই কৃষি বাজারে কৃষকদের ফসল কেনা-বেচা শুরু হয়নি আজও। এ নিয়ে এলাকার কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। কৃষিবাজারে চাষিদের ফসল বিক্রির সুযোগ কবে হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক চাপান উতোর শুরু হয়েছে শাসক ও বিরোধী শিবিরে।
বিধানসভার ভোটের ময়দানে পাঁশকুড়ায় এ বার বিষয়টা প্রাসঙ্গিক হয়েছে নন্দীগ্রামে জমি রক্ষা আন্দোলনের ‘শহিদ মাতা’ তথা বিধায়ক ফিরোজা বিবিকে প্রার্থী করায়। নন্দীগ্রাম বিধানসভায় প্রার্থী করা হয়েছে জমিরক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীকে। আর পাঁশকুড়ায় প্রয়াত বিধায়ক ওমর আলির শূন্য স্থানে প্রার্থী করে আনা হয়েছে নন্দীগ্রামের দু’বারের বিধায়ক ফিরোজা বিবিকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভোটের প্রচারে শাসক দলের পুঁজি হয়েছে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় তৎকালীন শাসক বাম সরকার ও সিপিএমের বিরুদ্ধে তোলা নানা সন্ত্রাসের অভিযোগ। আর তাই বাম-কংগ্রেস জোটের বিরুদ্ধে পাঁশকুড়ায় এবার কার্যত নন্দীগ্রামের জমি রক্ষার লড়াই ফিরোজা বিবির।
যে নন্দীগ্রামের দৌলতে ২০০৭ সালে পুরসভা ও ২০১১ সালে বিধানসভায় ঘাসফুল ফুটেছিল সেখানে লড়াই যে এবার বেশ শক্ত তা মানছেন শাসক দলের স্থানীয় নেতারাই। শাসকদলের হাতিয়ার, নন্দীগ্রামের জমিরক্ষা আন্দোলনের স্মৃতি উস্কে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে সন্ত্রাসের অভিযোগ, আর তৃণমূলের আমলে উন্নয়ন। হিসেবে দেখানো হয়েছে পাঁশকুড়ায় কৃষি বাজার, মেচগ্রামে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল, পাঁশকুড়া পুরসভা এলাকায় পানীয় জলপ্রকল্প এমনই নানা কিছু।
হার মানছে না অবশ্য বিরোধীরাও। নন্দীগ্রামের বিদায়ী বিধায়ককে পাঁশকুড়ায় এনে প্রার্থী করায় তাঁকে বহিরাগত তকমা দিতে ছাড়ছে না বিরোধী বামেরাও। পাঁশকুড়ার সিপিআই প্রার্থী চিত্তরঞ্জন দাশঠাকুর বলেন, ‘‘তৃণমূলের প্রার্থী নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। তাঁদের দল যাকে মনে করেছে প্রার্থী করেছে।’’ কিন্তু তৃণমূল যে উন্নয়নের হিসেব দেখাচ্ছে? সেখানেও যুক্তি রয়েছে তাঁর। বলেন, ‘‘ পাঁশকুড়ায় যে সরকারি কৃষিবাজার গড়া হয়েছে এখনও চালু হয়নি। সেখানে কৃষকদের উৎপাদিত সব্জি বিক্রির ব্যবস্থা হয়নি। আর সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল গড়া হলেও তা সম্পূর্ণভাবে চালু হয়নি। রোগীদের চিকিৎসার সমস্যা আছে।’’ বাম প্রার্থীর তোলা এইসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে ফিরোজা বিবি বলেন, ‘‘৩৪ বছর ধরে রাজ্যে ক্ষমতায় থেকে বামফ্রন্ট সরকার পাঁশকুড়ার মানুষের জন্য কিছু কাজ করেনি। পাঁশকুড়ায় নতুন হাসপাতাল হয়েছে। শহরে পানীয় জলপ্রকল্প হয়েছে। তাই বামেদের মুখে এখন আর উন্নয়নের কথা মানায় না।’’
নন্দীগ্রামের স্মৃতি ও পাঁশকুড়ায় উন্নয়নের কাজের খতিয়ান তুলে ধরে প্রচার চললেও গত বিধানসভা ও গত লোকসভা ভোটের হিসেব বলছে এ বার শাসকদলের লড়াই বেশ কঠিন। ২০১১ সালে বিধানসভা তৃণমূল-কংগ্রেস জোট প্রার্থী পেয়েছিল ৪৯.৯৭ শতাংশ ভোট। বামফ্রন্ট পেয়েছিল ৪৫.০৮ শতাংশ ভো। ২০১৪ লোকসভার ভোটে ঘাটাল কেন্দ্রের অধীনে থাকা এই বিধানসভায় তৃণমূলের ভোট কমে হয় ৪২.৯৫ শতাংশ। আর সেখানে বাম -কংগ্রেসের ভোট প্রাপ্তি ৪২.২৫ শতাংশ। রাজনৈতিক মহলের মতে, গত লোকসভা ভোটে অভিনেতা দেবের মতো তারকা প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে এই কেন্দ্রে এবার শাসকদল বেশ কঠিন লড়াইয়ে পড়েছে। তার উপর বাম-কংগ্রেস জোট হওয়ায় লড়াই আরও কঠিন।
ফলে পাঁশকুড়ার মাটিতে এ বার কার্যত রাজনৈতিক জমিরক্ষার লড়াই তৃণমূলের।