কাঁথি হাতছাড়া অধিকারী পরিবারের। —ফাইল চিত্র।
‘অধিকারীগড়’ বলে পরিচিত কাঁথি পুরসভার নিয়ন্ত্রণ হারালেন শিশির অধিকারী এবং তাঁর পরিবার। ফলাফল যে দিকে চলেছে, তাতে কাঁথিতে বোর্ড গড়ছে শাসক তৃণমূল। সম্ভাব্য পুরপ্রধান সুপ্রকাশ গিরি। যিনি ঘটনাচক্রে, জেলার রাজনীতিতে অধিকারী পরিবারের বিরোধী শিবিরের নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী অখিল গিরির পুত্র। কাঁথির ফলাফল নিয়ে অবশ্য এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি শুভেন্দু বা বিজেপি-র তরফে।
কাঁথি পুরসভায় মোট আসন ২১টি। তার মধ্যে ১৭টিই জিতেছে তৃণমূল। তিনটি গিয়েছে বিজেপি-র ঝুলিতে। কাঁথি উত্তরের দলীয় বিধায়ক সুমিতা সিংহকে পুরভোটে প্রার্থী করেছিল বিজেপি। তিনি তৃণমূলের কাছে হেরেছেন ৭৭ ভোটে। অবশ্য কাঁথি দক্ষিণের বিজেপি বিধায়ক অরূপ দাস ১৭৮ ভোটে জিতেছেন। জিতেছেন তাঁর আরও দুই সতীর্থও। একটি আসন পেয়েছেন নির্দল প্রার্থী। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী দল বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে কাঁথির মানুষের ‘আনুগত্য’-ও বদলে যাবে, এমন একটা ধারণা করেছিল অধিকারী পরিবার। কিন্তু ভোটের ফলাফল তো তেমন বলছেই না, উল্টে দেখা যাচ্ছে, পুরভোটে হেরেছেন কাঁথি উত্তরের বিজেপি বিধায়কও! বিষয়টি শুভেন্দুর পক্ষে আদৌ ‘সুখকর’ নয়। যেমন বিষয়টি ‘বিড়ম্বনা’-র প্রবীণ রাজনীতিক শিশিরের পক্ষেও।
ষাটের দশকের শেষলগ্নে শিশির অধিকারীর হাত ধরে কাঁথি পুরসভায় যাত্রা শুরু হয়েছিল অধিকারী পরিবারের। এ বারের পুরভোটের ফলে মুছে গেল সেই ‘ঐতিহ্য’। এ বার কাঁথি পুরসভার নির্বাচন যতটা না শাসকদল বনাম বিজেপি-র ছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল তৃণমূল বনাম রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুর লড়াই। ভোটের ফলাফল বলছে, সেই লড়াইয়ে পরাজয় হচ্ছে শুভেন্দুর। যিনি ‘ভোটলুঠ’-এর অভিযোগে মঙ্গলবার কাঁথি শহরে মোমবাতি মিছিল করেছিলেন। এবং শাসক শিবির বলেছিল, পরাজয় নিশ্চিত বুঝেই শুভেন্দু ‘ভোটলুঠ’-এর কথা বলতে শুরু করেছেন। পুরযুদ্ধে নিজের ‘খাসতালুক’-এ প্রথম থেকেই কোমর বেঁধেছিলেন শুভেন্দু নিজে। প্রতিটি ওয়ার্ডে বাড়ি বাড়ি জনসংযোগের চেষ্টাও চালিয়েছিলেন তিনি। নিজের সেই প্রচারকে ‘দুয়ারে শুভেন্দু’ বলেও ব্যাখ্যা করেছিলেন বিরোধী দলনেতা। কিন্তু দেখা গেল, শেষ পর্যন্তু সে সব কিছুই কাজে লাগেনি।
প্রসঙ্গত, কাঁথি পুরসভার ভোট নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছেন শুভেন্দুর ভাই তথা বিজেপি নেতা সৌম্যেন্দু অধিকারী। যিনি এর আগে কাঁথি পুরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। আদালতে তিনি ভোটগণনা স্থগিত রাখার আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু আদালত সেই নির্দেশ দেয়নি। আদালত নির্দিষ্ট নির্ঘন্ট অনুযায়ী গণনা জারি রাখতে বলে।
১৯৬৯ সাল থেকেই কাঁথি পুরসভার সঙ্গে জড়িয়ে অধিকারী পরিবার। ১৯৬৯ সালে কমিশনার হিসাবে কাঁথি পুরসভায় প্রথম পা রাখেন শিশির। তখন থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত পুরসভার চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি। এর পর ১৯৮৬-২০০৯ পর্যন্ত সময় ফের পুরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। তার পরে বাবার ছেড়ে যাওয়া আসনে ২০১০-২০২০ পর্যন্ত বসেছিলেন সৌম্যেন্দু। ২০২০ সালের পর ওই পুরসভার প্রশাসকও হন সৌম্যেন্দু।
তবে এই পুরভোটে নির্বাচন এবং ভোটের ফল ঘোষণার সময় যত এগিয়েছে, তত স্পষ্ট হয়েছে বিজেপি-র সংগঠনের ভগ্ন চেহারা। শেষ পর্যন্ত কাঁথির পুরভোটে কোনও রকম ‘প্রতিরোধ’ গড়তেই ব্যর্থ গেরুয়াবাহিনী। যে প্রসঙ্গে অখিল বলেছেন, ‘‘‘কাঁথির ভোট বাতিলের দাবিতে হাই কোর্টে মামলা থেকে গণনার আগের রাতে কাঁথি শহরে মোমবাতি মিছিল করে শুভেন্দু নিজের রাজনৈতিক ব্যর্থতাকেই ঢাকার চেষ্টা করেছেন।’’ অখিল আরও বলেন, ‘‘অধিকারী পরিবার দীর্ঘদিন ধরে কাঁথি পুরসভায় একচ্ছত্র শাসন করে স্বজনপোষণ এবং দুর্নীতি করেছে। কাঁথির মানুষ তাদের বিরুদ্ধে। তারা মানুষের জন্য কাজ করেনি।’’ অখিলের ব্যাখ্যা, ‘‘এ বার কাঁথির নির্বাচনে অধিকারী পরিবারের দীর্ঘদিনের অশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইটাই মুখ্য হয়ে উঠেছিল। আবার অন্য দিক থেকে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের জনমুখী প্রকল্প বনাম কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের মূল্যবৃদ্ধির লড়াইও ছিল। সবেতেই মুখ থুবড়ে পড়েছে শুভেন্দু। আগামী দিনে এই পরিবারের নাম রাজনীতি থেকেই মুছে যাবে।’’
এরপর কি অখিলের পুত্র সুপ্রকাশই কাঁথি পুরসভার চেয়ারম্যান হবেন? অখিল বিষয়টি দলের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন। যেমন ছেড়ে দিয়েছেন সুপ্রকাশও। তবে তাঁকে সামনে রেখেই তৃণমূল এই পুরভোটে লড়েছিল। ফলে চেয়ারম্যান পদের জন্য অখিলপুত্রে একটা দাবি তো থাকবেই। তেমন হলে কি গিরি পরিবারের বিরুদ্ধেও ‘পরিবারতন্ত্র’-এর অভিযোগ উঠবে না? অখিলের জবাব, ‘‘আমি নিজে কখনও পুরভোটে লড়িনি। আর এই প্রথম আমার পরিবারের কেউ পুরভোটে লড়েছে। ফলে আমাদের বিরুদ্ধে অধিকারীদের মতো পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ তোলা যাবে না।’’