ফাইল চিত্র।
বছর ঘুরলেই পঞ্চায়েত ভোট। তারপরে রয়েছে লোকসভা নির্বাচন। রাজ্যের উন্নয়নের কাজের গতি বহাল রাখতে তাই সচেষ্ট তৃণমূল সরকার। সেই উন্নয়ের জন্য কেন্দ্র অর্থ বরাদ্দ করেছে না বলে রাজ্য সরকার মাঝে মধ্যে অভিযোগও করেন। কিন্তু, পূর্ব মেদিনীপুরে তৃণমূলের দুই সাংসদ শিশির এবং দিব্যেন্দু অধিকারী সম্প্রতি আবার উল্টো অভিযোগ করছেন। কাঁথি এবং তমলুকের ওই দুই তৃণমূল সাংসদের দাবি, কেন্দ্রের তরফে দেওয়া এলাকার উন্নয়ন তহবিলের টাকা খরচ করা হচ্ছে না পূর্ব মেদিনীপুরে।
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তথা বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারীর বাবা শিশির অধিকারী এবং ভাই দিব্যেন্দু এখনও খাতায়-কলমে তৃণমূলের সাংসদ। তমলুকের সাংসদ দিব্যেন্দু বলছেন, ‘‘মার্চের আগে দু’কোটি টাকার প্রকল্প জমা দিয়েছিলাম। অথচ এখনও পর্যন্ত সেই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কাজই শুরু করেনি জেলাশাসকের দফতর। পুনরায় প্রস্তাব বানিয়ে জেলাশাসকের দফতরে পাঠাব বলে ঠিক করেছি।’’ একই অভিযোগ কাঁথির প্রবীণ সাংসদ তথা দিব্যেন্দুর বাবা শিশিরবাবুর। তিনি বলেন, ‘‘রাস্তাঘাট-সহ এলাকার উন্নয়নের একগুচ্ছ প্রকল্প রূপায়ণের জন্য দু কোটি টাকার স্কিম পাঠিয়েছিলাম আগে। চলতি আর্থিক বছরে ফের সাংসদ তহবিলে পাঁচ কোটি টাকা পাঠানো হবে। কিন্তু আগের প্রকল্পের কাজই তো এখনও শুরু হল না।’’
জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, সাংসদ বা বিধায়কের উন্নয়ন তহবিলে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার অর্থ বরাদ্দ করে এবং তা জেলাশাসকের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তাঁদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থে কী প্রকল্প রূপায়ণ করা যেতে পারে বা কোন সামাজিক কাজে তা খরচ করা হবে— সে বিষয়ে কোনও সাংসদ বা বিধায়ককে জেলাশাসকের দফতরে লিখিত (স্কিম) ভাবে আর্জি পাঠাতে হয়। তাতে কোন সংস্থার মাধ্যমে ওই কাজ সাংসদ বা বিধায়ক করাতে চান, তারও উল্লেখ রাখতে হয়। সেই স্কিম পর্যালোচনা করে দেখেন ‘ডিপিএলও’। একই প্রকল্প আগে কখনও রূপায়ণ করা হয়েছে কি না, সেই বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। আর প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর ‘ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট’ জেলাশাসকের দফতরে জমা দিতে হয় সাংসদ, বিধায়ককে। তার পরেই পরবর্তী সময়ের কোনও তহবিলের প্রকল্পের ছাড়পত্র মেলে।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য কিছুদিন ধরে সাংসদদের এলাকার উন্নয়ন তহবিল বা সামাজিক কর্মসূচিতে অর্থ খরচ করার জন্য বরাদ্দ বন্ধ করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। তবে গত বছর নভেম্বর থেকে সাংসদ তহবিলের জন্য ফের ওই বরাদ্দ শুরু করা হয়। ২০২১-২২ আর্থিক বছরের বাকি থাকা কয়েক মাসের জন্য সাংসদদের দু’কোটি টাকা করে এবং চলতি আর্থিক বছরে পাঁচ কোটি টাকা অনুমোদন করার কথা ঘোষণা করে কেন্দ্র। জেলার ১৬ জন বিধায়কের এলাকার উন্নয়নের জন্য রাজ্য সরকারের কাছ থেকেও গত বছর ৬০ লক্ষ টাকা করে তহবিল এসেছে। তাঁরা এলাকার উন্নয়নের জন্য স্কিম জমা দিয়েছেন এবং সেই কাজও চলছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর। মহিষাদলের তৃণমূলের বিধায়ক তিলক চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘গত আর্থিক বছরে প্রথম কিস্তির ৩০ লক্ষ টাকার কাজের ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট জমা দিয়েছি। দ্বিতীয় পর্বের ৩০ লক্ষ টাকার কাজের প্রকল্প জমা দিয়েছি। তারও কাজ চলছে।’’ বিধায়ক তহবিলের টাকায় এলাকার উন্নয়নের কাজ আটকাচ্ছে না বলে দাবি করেছেন খেজুরির বিজেপি বিধায়ক শান্তনু প্রামাণিকও।
তাহলে খাতায়-কলমে শাসকদলের হওয়া সত্ত্বেও কাঁথি এবং তমলুকের দুই সাংসদের তহবিলের গত আর্থিক বছরের টাকা কেন খরচ করা হচ্ছে না, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যদিও পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাজি বলছেন, ‘‘র্দিষ্ট করে কোন স্কিমের কাজ হচ্ছে না তা জানাতে হবে। তাছাড়া ওঁরা যে সব সংস্থার মাধ্যমে নিজেদের স্কিমের কাজ করাতে চেয়েছিলেন, ওই সংস্থাগুলির ভূমিকাও খতিয়ে দেখতে হবে।’’
উল্লেখ্য, ২০০৯ সাল থেকে পরপর তিনবার কাঁথি লোকসভা কেন্দ্র থেকে সাংসদ হন শিশির। আর ২০১৬ সালে তৃণমূলের থাকাকালীন শুভন্দু রাজ্যের মন্ত্রী হওয়ায় তমলুকের সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দেন। তারপর উপনির্বাচনে তমলুকের সাংসদ নির্বাচিত হন দিব্যেন্দু। ২০১৯ সালেও তিনি সেখানে দ্বিতীয়বার তৃণমূলের টিকিটে জয়ী হয়ে সাংসদ হন। কিন্তু ২০২০ সালে শুভেন্দু তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওযার পরেই অধিকারী পরিবারের সঙ্গে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। গত বিধানসভা ভোটের আগে শিশিরবাবুকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের প্রচার সভামঞ্চে দেখা গিয়েছিল। তার পরে শিশিরের সাংসদ পদ বাতিলের জন্য লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার কাছে দাবি জানিয়েছে তৃণমূল।
এখন ওই দুই সাংসদের তহবিলের টাকা খরচ না হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার তত্ত্ব সামনে আসছে। এ প্রসঙ্গে বিজেপির কাঁথি সাংগঠনিক জেলা সভাপতি সুদাম পণ্ডিত বলেন, ‘‘বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুর ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য ওঁর পরিবারের বাকি সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা রকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রাজ্য সরকার।’’
অবশ্য, অভিযোগ অস্বীকার করেছে শাসকদল। এগরার শাসকদলের বিধায়ক তথা কাঁথি সাংগঠনিক জেলা তৃণমূল সভাপতি তরুণ মাইতি বলেন, ‘‘সাংসদ তহবিলের টাকা ঠিক মত খরচ না হওয়ার অভিযোগের সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। সাংসদ বা বিধায়কদের বিভিন্ন স্কিম ভেটিং করে জেলাশাসকের দফতরে পাঠাতে হয়। তারপর আধিকারিকরা ওইসব প্রকল্পের খুঁটিনাটি যাচাই করে দেখেন। এক্ষেত্রে প্রশাসনের কোন স্তরে ওই দুই সাংসদের জমা দেওয়া প্রকল্প আটকে রয়েছে, তা আমরা বলতে পারব না।’’