কর্মস্থল হিসেবে বেশিরভাগ চিকিৎসকেরই পছন্দ শহর। ফলে গ্রামে চিকিৎসকের অভাব থাকছেই। Sourced by the ABP
সমস্যার মূলে কি মানসিকতা?
গ্রামের অনেক ছেলেই চিকিৎসক হচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের একাংশ গ্রামে কাজ করতে চাইছেন না। কর্মস্থল হিসেবে বেশিরভাগ চিকিৎসকেরই পছন্দ শহর। ফলে গ্রামে চিকিৎসকের অভাব থাকছেই।
সাধারণত এমডি বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হলে সবচেয়ে নীচু স্তর হিসেবে মহকুমা হাসপাতালে পোস্টিং পাওয়া যায়। এমবিবিএস চিকিৎসক হলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা গ্রামীণ হাসপাতালে পোস্টিং মেলে। নিজের জেলার গ্রামে পোস্টিং পেয়েও অনেক চিকিৎসক সেখানে থাকেন না। শহরে থেকে সেখানে যাতায়াত করেন। জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, গড়ে ১০০ জন চিকিৎসককে গ্রামে যেতে বলা হলে, তার মধ্যে ৭০-৮০ জন যান। বাকিরা যান না। গ্রামে পোস্টিং হয়েছে জানলে একাংশ চিকিৎসক সরকারি কাজে যোগও দেন না।
ঝাড়গ্রাম জেলার অনেক চিকিৎসকের বাড়ি গ্রামীণ এলাকায় হলেও তাঁরা বর্তমানে শহরে থাকেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের এক স্বাস্থ্য আধিকারিকও মানছেন, "গ্রামে পোস্টিং পেলে কেউ কেউ সরকারি চাকরিতে যোগ দেন না। কেউ চাকরিতে যোগ দিতে না চাইলে, তাঁকে তো জোর করা যায় না। ধরে নেওয়া যায়, তিনি অন্য কোথাও কাজের সুযোগ পেয়ে গিয়েছেন।"
পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম দুই জেলাতেই সরকারি চিকিৎসকের সংখ্যা কম রয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় একটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পাশাপাশি চারটি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল, ২০টি গ্রামীণ হাসপাতাল, একটি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ৯০টির বেশি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ৭০০টির বেশি উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে মেডিক্যাল কলেজ বাদে এ জেলায় চিকিৎসক রয়েছেন প্রায় ২২০ জন। মেদিনীপুর মেডিক্যালে চিকিৎসক রয়েছেন প্রায় ১৫০ জন। জুনিয়র ডাক্তার ধরলে সংখ্যাটা প্রায় ৫০০। ঝাড়গ্রামে নয়াগ্রাম ও গোপীবল্লভপুর সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে চিকিৎসকের ঘাটতি বেশি। ঝাড়গ্রাম জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক আধিকারিকের আক্ষেপ, ‘‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা শহরে থাকতে বেশি পছন্দ করেন। কারণ, শহরে তাঁদের প্র্যাকটিস করতে সুবিধা হয়।’’
গ্রামে চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দিতে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের গুরুত্ব অনেকটাই। কিন্তু অনেক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই চিকিৎসক অনিয়মিত আসেন বলে অভিযোগ। যদিও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে ২৪ ঘণ্টাই চিকিৎসক থাকার কথা। এর জন্য সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ক্যাম্পাসের মধ্যে চিকিৎসকদের আবাসন থাকে। কিন্তু সেখানে চিকিৎসকরা খুবই কম থাকেন। ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিকদেরও (বিএমওএইচ) গ্রামীণ হাসপাতালের ক্যাম্পাসে ২৪ ঘণ্টা থাকার কথা। তবে দুই জেলায় অধিকাংশ বিএমওএইচই ক্যাম্পাসে থাকেন না। ঝাড়গ্রামের মুখ স্বাস্থ্য আধিকারিক ভুবন চন্দ্র হাঁসদা বলেন, ‘‘গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে চিকিৎসকদের থাকার জন্য ন্যূনতম পরিষষেবা থাকা উচিত। সেই জায়গায় খামতি নেই, তা বলতে পারব না। আমরা ধাপে ধাপে সংস্কার করছি। কিছু জায়গা সত্যি থাকার অনুপোযুক্ত রয়েছে।’’
শুধু প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নয়, মেদিনীপুর মেডিক্যালেও একাংশ সিনিয়র ডাক্তার নিয়মিত আসেন না বলে অভিযোগ। হাসপাতালের ডিউটি এড়িয়ে তাঁরা প্রাইভেট প্র্যাকটিসে ব্যস্ত থাকেন। সদ্য চালু হওয়া ঝাড়গ্রাম মেডিক্যাল কলেজের সিনিয়র চিকিৎসক বা বিভাগের প্রধানরাও নিয়মিত আসেন না। পশ্চিম মেদিনীপুরের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সৌম্যশঙ্কর সারেঙ্গীর অবশ্য দাবি, "জেলায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক রয়েছেন। স্বাস্থ্য পরিষেবা মসৃণ রাখার সব রকম চেষ্টা চলে। স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নজরদারিও থাকে।"
উল্টো ছবিও আছে। গ্রামের ছেলে হয়ে গ্রামের মানুষের চিকিৎসা করতেই পছন্দ করেন সাহ্নিক ঘটক। গড়বেতার ঝাড়বনির বাসিন্দা এই চিকিৎসক কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস করে এখন গড়বেতা গ্রামীণ হাসপাতালে জেনারেল ফিজিশিয়ান হিসেবে নিযুক্ত আছেন। তাঁর কথায় , "আমাদের যেখানেই পোস্টিং দিক, সেখানেই তো কাজ করতে হবে। এখানে আমি আড়াই বছর ভাল ভাবেই আছি। আমার মনে হয় চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের বাছবিচার করা ঠিক নয়। আমরা তো মানুষেরই চিকিৎসা করব। তো সেখানে গ্রাম-শহর প্রাধান্য পাবে কেন!" (শেষ)
তথ্য সহায়তা: রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য, বরুণ দে, রঞ্জন পাল