পিঠে বানাচ্ছেন সাঁওতালি সিনেমার অভিনেত্রী বিরবাহা হাঁসদা। নিজস্ব চিত্র।
কাঠের জ্বালের ঢিমে আঁচ। তাওয়ায় শালপাতা মোড়া পিঠে। তেল, কাঁচা শালপাতা আর পিঠের সুবাস মিশে ভেসে বেড়াচ্ছে উঠোনময়। সেই সুঘ্রাণে আধা-খাওয়ার স্বাদ পাওয়া কয়েকজন পর্যটক উনুন ঘিরে। দেখছেন মাঁস পিঠের প্রস্তুতি। মকর পরবে মেতে ওঠা জঙ্গলমহলের পর্যটকদের জন্য এমনই ব্যবস্থা করেছে কয়েকটি অতিথিশালা আর হোম স্টে। শীতের সফরে বার-বি-কিউ নয়, পিঠে তৈরি দেখা ও খাওয়ার ব্যবস্থা।
বুধবার রাত থেকে টুসু পুজো দিয়ে শুরু হয়েছে মূলবাসীদের প্রধান উৎসব মকর। পরব উপলক্ষে এই সময়ে বাড়ি-বাড়ি হরেক পিঠে তৈরি হয়। যা স্বাদে-বৈচিত্রে একেবারেই জঙ্গলমহলের নিজস্ব ঐতিহ্য বলা চলে। তবে মকর পরবের মূল আকর্ষণ হল ‘মাঁস পিঠা’ বা মাংস পিঠে। ঝাড়গ্রামে বেড়াতে আসা অতিথিরা এই প্রথমবার স্থানীয় পিঠের স্বাদ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
পর্যটন দফতর স্বীকৃত ‘ঝাড়গ্রাম ট্যুরিজম’ সংস্থার পরিকল্পনায় জেলার বেশ কিছু হোম স্টে ও অতিথিশালায় পিঠের স্বাদ নেওয়া যাবে। পর্যটকেরা মূলবাসীদের বাড়ির উঠোনে গিয়েও দেখতে পারেন পিঠের প্রস্তুতি। এ জন্য বাড়তি খরচ নেই। তবে গ্রামে গিয়ে পিঠে তৈরি দেখতে হলে পরিবহণ খরচ লাগবে। সংস্থার কর্তা সুমিত দত্ত জানান, বৃহস্পতি ও শুক্রবার পরবের দিনে ঝাড়গ্রামের হোম স্টেগুলোর পর্যটকদের জন্যই মূলত প্রথমবার এই আয়োজন। কয়েকটি অতিথিশালায়ও মিলবে পিঠে-পরিষেবা। সুমিতের কথায়, ‘‘জঙ্গলমহলের নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতির সঙ্গে পর্যটকদের পরিচয় করানোর উদ্দেশ্যেই এমন উদ্যোগ।’’
ঝাড়গ্রাম শহরের বাসিন্দা বিশিষ্ট ঝুমুরসঙ্গীত শিল্পী ইন্দ্রাণী মাহাতোর মা শান্তিলতা বলেন, ‘‘মূলত, হাঁস বা মুরগির মাংসের খুব ছোট ছোট টুকরো দিয়ে মাংস পিঠে তৈরি করা হয়। খাসির মাংস হলে কিমা করে নিতে হবে। চালগুঁড়ির সঙ্গে কষা মাংস মিশিয়ে তৈরি হয় রুটির আকৃতির এই পিঠে। কাঠের জ্বালের ঢিমে আঁচে লোহার তাওয়ার উপরে সর্ষের তেল মাখানো বড় গোল শালপাতার উপরে এই পিঠে তৈরি করা হয়।’’ শান্তিলতা জানালেন, ছাঁকা তেলে ভাজা লুচির মতো ‘মশলা পিঠা’, গোলাকার ‘গুড় পিঠা’, নারকেলের পুর দেওয়া ‘ভাপা পিঠা’, লাউয়ের তরকারির সঙ্গে চালগুঁড়ি মিশ্রণে তৈরি সরুচাকলির মতো লাউ পিঠা, চাল গুঁড়ির সঙ্গে কাঁচা ডিমের মিশ্রণ দিয়ে তৈরি সুস্বাদু ডিম পিঠাও এ সময়ে ঘরে ঘরে তৈরি হয়। সিম পিঠা, দোপাটা, পাটিসাপ্টা, মাটির খোলায় তৈরি ‘খোলা পিঠা’, দুধপুলি এসব তো রয়েছেই। শান্তিলতা জানালেন, গ্রামে-গঞ্জে পিঠে তৈরির সময় মহিলারা টুসুর গান করেন। শান্তিলতা যখন পিঠে বানান, তখন তাঁর মেয়ে ইন্দ্রাণী গেয়ে ওঠেন প্রয়াত ঝুমুরসম্রাট বিজয় মাহাতোর বিখ্যাত গান ‘মাঁস পিঠা হবেক মকরে’। বলেন, ‘‘বাড়িতে পিঠে তৈরি দেখার জন্য পর্যটকেরা বৃহস্পতিবার আসবেন।’’
ঝাড়গ্রামের গড়শালবনির একটি অতিথিশালার মালিক রাজেশ মাহাতো, নকাট গ্রামের হোম স্টে-র মালিক শুভাশিস দেবসিংহ, বেলপাহাড়ির কাঁকড়াঝোরের হোম স্টের কর্তা সিন্টু ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, পরবের সময়ে পর্যটকেরাও যাতে পিঠের স্বাদ থেকে বঞ্চিত না হন, সেজন্য বিনামূল্যে পিঠে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। অরণ্যশহরের বিদ্যাসাগর পল্লির বাসিন্দা সাঁওতালি সিনেমার অভিনেত্রী বিরবাহা হাঁসদা বলেন, ‘‘বুধবার রাতেই আমি ও মা মিলে মাঁস পিঠে বানিয়েছি। কয়েকজন পর্যটক পিঠে তৈরি দেখতে এসেছিলেন।’’ গড়িয়া থেকে বেড়াতে আসা বিজয়কুমার রায় বলেন, ‘‘সত্যিই পিঠের অতুলনীয় স্বাদ। পৌষ পার্বণের সময়ে বেড়াতে এসে একেবারে অন্যরকম অভিজ্ঞতা হল।’’