পুকুরের জলই পরিস্রুত করে সরবরাহ

ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়— সে কথাই প্রমাণ হল কাঁথিতে। বিশুদ্ধ পানীয় জল সেখানে পাওয়া দায়। নলকূপও নিষিদ্ধ। ভরসা শুধুই পুকুর। সেখান থেকেই রান্নার জল বা পানীয় জল যেমন নেওয়া হয়, তেমনই চলে বাসন মাজা, হাত মুখ ধোওয়া। ফলে জলবাহিত রোগভোগ নিত্য সমস্যা। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পুকুরের জলকেই পরিস্রুত করার ব্যবস্থা করে ফেলেছে ব্লক প্রশাসন।

Advertisement

সুব্রত গুহ

কাঁথি শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৫ ০১:১২
Share:

প্রকল্পের জলাধার থেকে জল নিচ্ছেন গ্রামের মহিলারা। দুরমুঠ গ্রামে সোহম গুহর তোলা ছবি।

ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়— সে কথাই প্রমাণ হল কাঁথিতে। বিশুদ্ধ পানীয় জল সেখানে পাওয়া দায়। নলকূপও নিষিদ্ধ। ভরসা শুধুই পুকুর। সেখান থেকেই রান্নার জল বা পানীয় জল যেমন নেওয়া হয়, তেমনই চলে বাসন মাজা, হাত মুখ ধোওয়া। ফলে জলবাহিত রোগভোগ নিত্য সমস্যা। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পুকুরের জলকেই পরিস্রুত করার ব্যবস্থা করে ফেলেছে ব্লক প্রশাসন।

Advertisement

পদ্ধতি হিসাবে এসেছে চিরাচরিত সেই পরিস্রবণ। বিজ্ঞান বইয়ে পড়া নুড়ি-বালির পরীক্ষা যে তাঁদের জীবনে এমন প্রত্যক্ষ হয়ে উঠবে ভাবতেই পারেনি দুরমুঠ দেশপ্রাণ মধ্যশিক্ষা কেন্দ্রের সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়া রামকুমার মণ্ডল বা মিতালি কর্মী। তারা খুশি, স্কুলের ভিতরেই এখন ভাল জল পাওয়া যায়। অন্য দিকে খুশি প্রশাসনের কর্তারাও। প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা ব্যয়ে এমজিনারেগা প্রকল্পের আওতায় কাঁথি ৩ ব্লকের দুরমুঠ গ্রামে বসানো হয়েছে জলাধার। সেখানে সাতটি কক্ষ পার হয়ে পরিশুদ্ধ জল এসে পৌঁছবে গ্রাহকের হাতে। ব্লক উন্নয়ন দফতরের দাবি সারা রাজ্যে এই ব্যবস্থা প্রথম।

কাঁথি ৩ ব্লকের ৪৬টি মৌজা ‘নন টিউবওয়েল জোন’। তাই এখানকার গ্রামের বাসিন্দারা পানীয় হিসাবে এবং রান্নায় ব্যবহার করেন পুকুরের জল। ব্লকের ১৯টি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুলেও পুকুরের জলেই রান্না হয় মিড ডে মিল। এমনকী কোনও কোনও গ্রামে পুকুর না থাকায় অনেক দূর থেকে পুকুরের জল বয়ে এনে মিড ডে মিলের রান্না করতে হয়। ফলে নিরাপদ বিশুদ্ধ পানীয় জল স্কুলের পড়ুয়া বা গ্রামবাসীদের কাছে অলীক স্বপ্ন মাত্র।

Advertisement

তবে প্রতিশ্রুতির অভাব ছিল না কোনও দিন। পানীয় জলের সমস্যা নিরসনে স্থানীয় পঞ্চায়েত থেকে প্রশাসন সব মহলই বাবারবার নানা আশ্বাস দিয়েছে, বাস্তবায়িত হয়নি কোনটিই। এ বারে অবশ্য কিছুটা উদ্যোগী হয়েছে প্রশাসন। কাঁথি ৩ ব্লকের পানীয়জলের বিডিও প্রদীপ্ত বিশ্বাস কিছুদিন আগে জানিয়েছিলেন, পুকুরের জলকেই পরিস্রুত করে বিশুদ্ধ পানীয় জল হিসেবে পৌঁছে দেওয়াটা একটা সমাধান হতেই পারে।

আর সে কথা ভেবেই তাঁরা কাজ শুরু করেন। পুকুরের জলকে জলাধারে রেখে, তা পরিস্রবণ পদ্ধতিতে বিশুদ্ধ পানীয় জল হিসেবে গ্রামবাসীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। তরুণ আধিকারিক প্রদীপ্তবাবুর দাবি, “পরিস্রবণ পদ্ধতিতে পুকুরের জলকে পানীয় জলে রূপান্তরিত করার এই ধরনের প্রকল্প শুধু পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় নয়, সারা রাজ্যের মধ্যেই প্রথম উদ্যোগ।’’

এই ব্লকে মোট ১৬৬টি মৌজা। তার মধ্যে ৪৬টি মৌজাতেই পানীয় জলের সঙ্কট। এইসব মৌজাগুলি মূলত ‘নন টিউবওয়েল জোন’ হওয়ার দরুন পুকুরের জলকেই পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার করতে বাধ্য হন গ্রামবাসীরা। সে জল একদিকে যেমন বিশুদ্ধ নয়, তেমনই গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে পুকুরগুলিও শুকিয়ে গিয়েছে। আপাতত দুরমুঠ অঞ্চলে পুকুরের জলকে পরিস্রবণ পদ্ধতিতে পানীয় জল হিসেবে ৪টি মৌজার বাসিন্দাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ব্লক প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এমজিনারেগা প্রকল্পের প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা ব্যয় করে ব্লকের দুরমুঠ গ্রাম পঞ্চায়েতের দেশপ্রাণ কলেজ চত্বরে একটি জলাধার তৈরি করা হয়েছে। ৫০০লিটার জল ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ওই জলাধারটিতে মোট সাতটি কক্ষ রয়েছে। তিনটি পাথর ও দু’টি বালি বোঝাই কক্ষ রয়েছে। পাম্পের সাহায্যে পুকুরের জল ওই কক্ষগুলির মধ্যে দিয়ে পরিশ্রুত করা হয়। রয়েছে ক্লোরিন মেশানোর ব্যবস্থাও। পুকুরের জল পরিশুদ্ধ হওয়ার পর তা পানীয়জল হিসেবে সপ্তম কক্ষে মজুদ রাখা হচ্ছে। জল পরিশুদ্ধ করার জন্য তিন রকমের বিভিন্ন আকারের বিশেষ পাথর উত্তরবঙ্গ থেকে নিয়ে আসা হয়েছে।

গত ২১ এপ্রিলেই চালু হয়ে গিয়েছে জলাধার। ৪টি মৌজার তিনশোটি পরিবারকে প্রতিদিন ৩০ লিটার করে পানীয় জল সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলেও বিডিও জানিয়েছেন। খুশি এলাকার বাসিন্দারাও। দুরমুঠ গ্রামের বাসিন্দা খোকন বড়াই, মালতী দেবনাথের কথায়, “আগে জল আনতে যেতে হত হয় কাঁথি শহরে না-হলে পাশের কাজলা গ্রামে। জারিকেন ভর্তি করে ভ্যান রিকশা বা সাইকেলে করে নিয়ে আসতে হত। সে সমস্যা মিটেছে। গ্রামেই পানীয় জল পাওয়া যাচ্ছে।’’

স্কুল গুলিতেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন শিক্ষকেরা। দেশপ্রাণ মধ্যশিক্ষা কেন্দ্রের প্রধান শিক্ষক ব্রহ্মণ্যদেব ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘অনেকটাই আশ্বস্ত আমরা। আগে ভয় করত মিড ডে মিলের রান্না খেয়ে বা জল খেয়ে পড়ুয়ারা অসুস্থ না হয়ে পড়ে।’’

তবে এই জলাধার নিতান্তই পরীক্ষামূলক। অন্য ‘নন-টিউবওয়েল জোন’-এর জন্যও পানীয় জলের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। অন্যদিকে এই জলাধারের রক্ষণাবেক্ষণও এক জটিল সমস্যা। বিডিও প্রদীপ্ত বিশ্বাস বলেন, ‘‘আপাতত যে ঠিকাদার সংস্থা জলাধার তৈরি করেছে তাদের উপরই রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রয়েছে। তাদের কর্মীরাই নল খোলা বা বন্ধ করা, জলে ক্লোরিন মেশানোর কাজগুলি করছেন। পরবর্তীতে স্থায়ী বা অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement