পশ্চিম মেদিনীপুরে এইচআইভি সংক্রমিতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
মাস খানেক আগে একটি স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবিরে এসেছিলেন কাকলি দাস (নাম পরিবর্তিত) নামে এক বিবাহিত ওই মহিলা। প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা মহিলার রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে নড়েচড়ে বসেন পশ্চিম মেদিনীপুরের স্বাস্থ্য আধিকারিকেরা। রিপোর্টে দেখা যায়, বছর পঁয়ত্রিশের কাকলি এইচআইভি সংক্রমিত। গোপনে ওই গৃহবধূর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন স্বাস্থ্য আধিকারিকেরা।
পশ্চিম মেদিনীপুরে এইচআইভি সংক্রমিতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক সূত্রে খবর, চলতি বছরে এই জেলায় এখনও পর্যন্ত নতুন করে ১৩ জন এইচআইভি সংক্রমিতের খোঁজ মিলেছে। এরমধ্যে ৩ জন গর্ভবতী। ২০১০ সালে যেখানে জেলায় এইচআইভি সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ছিল ৬৫২ জন, এই ২০১৯ সালে সেখানে ওই সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে ১,৫০৩ জন। এইচআইভি সংক্রমিতের সংখ্যা সব থেকে বেশি ঘাটাল মহকুমাতেই। জেলার বাকি দু’টি মহকুমায় তুলনায় অনেক কম। পরিস্থিতি দেখে উদ্বিগ্ন জেলার একাংশ স্বাস্থ্য আধিকারিকও। জেলার এক স্বাস্থ্য আধিকারিকের কথায়, ‘‘নতুন করে এইচআইভি সংক্রমিতের সংখ্যা বাড়ছে জেলায়। এইচআইভি আক্রান্তদের মধ্যে যেমন গৃহবধূ রয়েছে, তেমন যুবক-যুবতী, এমনকি কিশোর-কিশোরীও রয়েছে। ’’
বছর ঘুরে ফের হাজির বিশ্ব এড্স দিবস। আজ, রবিবার পশ্চিম মেদিনীপুরেও দিনটি পালন হবে। নানা সচেতনতামূলক কর্মসূচি হবে। হবে পদযাত্রা, আলোচনা সভা। কিন্তু সেই প্রচারের ঢক্কানিনাদই সার! কেন এই পরিস্থিতি?
পশ্চিম মেদিনীপুরের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরার ব্যাখ্যা, ‘‘আগে এত শিবির হত না। এখন বেশি শিবির হচ্ছে। শিবিরে এইচআইভি শনাক্তকরণও হচ্ছে। তাই নতুন রোগীর খোঁজ মিলছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘যাঁদের রক্তে এইচআইভি সংক্রমণ মিলছে, তাঁদের কাউন্সেলিং করে গোপনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ফলে, এ নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই।’’ সচেতনতা কী তৈরি হচ্ছে না? গিরীশচন্দ্র বলেন, ‘‘এড্স নিয়ে সচেতনতা রয়েছে। তবে সর্বত্র সমান সচেতনতা এখনও গড়ে ওঠেনি। এ নিয়ে সচেতনতা আরও বাড়ানো দরকার। এদিকে নজরও দেওয়া হয়েছে।’’
জেলার উপ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সৌম্যশঙ্কর সারেঙ্গি জানান, ‘‘এখন মানুষের মধ্যে সচেতনতা অনেকটা বেড়েছে। তাই তাঁরা পরীক্ষা করাতে নিজেরাই এগিয়ে আসছেন।’’ জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মধ্যে দাসপুর-১, দাসপুর-২, ঘাটাল ব্লকেই বেশি সংখ্যক এইচআইভি সংক্রমিতের বসবাস। এখন দাসপুর-১ ব্লকে ৮৩ জন, দাসপুর-২ ব্লকে ৬২ জন এবং ঘাটালে ৬২ জন এইচআইভি সংক্রমিত রয়েছে। যে সব এলাকার যুবকেরা কাজের খোঁজে ভিন্ রাজ্যে চলে যান, মাস কয়েক সেখানে কাটিয়ে ফের ঘরে ফিরে আসেন, সেই সব এলাকাতেই এইচআইভি সংক্রমিতের সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ, কাজের খোঁজে যারা ঘর ছাড়েন, তাদেরই কয়েকজন এইচআইভির বাহক হয়ে এলাকায় ফেরেন। ওই স্বাস্থ্য আধিকারিক মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘যৌন রোগ সম্পর্কে মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে। কারণ, একজন নানা কারণে এইচআইভি সংক্রমিত হতে পারেন। এরমধ্যে যৌনপল্লিতে যাতায়াতও অন্যতম কারণ। এইচআইভি সংক্রমিতদের চিকিৎসা শুরু করা সবথেকে বেশি জরুরি। কিন্তু অনেকেই সমাজের মূলস্রোত থেকে দূরে সরে যাওয়ার ভয়ে এই মারণ রোগকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করেন।’’
জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক আধিকারিক জানান, এইচআইভি সংক্রমিতদের চিহ্নিত করতে পশ্চিম মেদিনীপুরে ১৩টি আইসিটিসি (ইন্টিগ্রেটেড কাউন্সেলিং টেস্টিং সেন্টার) রয়েছে। ওই আধিকারিকের আশ্বাস, যদি কেউ জানতে পারেন যে তিনি এইচআইভি সংক্রমিত হয়েছেন, তাহলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এইচআইভি সংক্রমণ নিয়েও একজন মানুষ দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারেন। তবে তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি জানাচ্ছেন, যৌন সংসর্গের সময়ে কন্ডোম ব্যবহার করতে বলে বিভিন্ন স্তরে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হয়। তারপরেও নতুন করে অনেক এইচআইভি সংক্রমিতের খোঁজ মিলছে। সংক্রমিতদের মধ্যে কমবয়সীরাও রয়েছে। এটাই উদ্বেগের।