মেদিনীপুর মেডিক্যালে সোনার ব্যবসায়ী উত্তম দাস।
ফের দুষ্কৃতীর দাপট দেখল রাতের রেলশহর। বাড়ির সামনে গুলিবিদ্ধ হলেন খড়্গপুরের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী। গুলিতে জখম হন পথচলতি এক কাঠমিস্ত্রিও। শুক্রবার রাতে এই ঘটনার পরে আতঙ্কিত শহরবাসী।
ঘটনাটি ঘটেছে খড়্গপুর শহরের মালঞ্চ টাটাব্যাঙ্কের কাছে। বাড়ির কাছেই দোকান সোনার ব্যবসায়ী বছর পঞ্চাশের উত্তম দাসের। রোজকার মতো শুক্রবারও রাত দশটা নাগাদ দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। তাঁর বাড়ির সামনে ঘুরতে থাকা তিনজন যুবকের একজন উত্তমবাবুকে খুব কাছ থেকে গুলি করে। গুলি লাগে উত্তমবাবুর বুকে। জখম অবস্থাতেই তিনি হাতে থাকা টাকা ও গয়নার ব্যাগটি বাড়ির দিকে ছুড়ে দেন। তারপর চিৎকার শুরু করে। সেই সময় পরপর গুলি ছোড়ে দুষ্কৃতীরা। একটি গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে কয়েক হাত দূরে পানের দোকান থেকে বেরনো সুনীল শর্মা নামে এক কাঠ মিস্ত্রির কাঁধে গিয়ে লাগে। স্থানীয় লোকজন জড়ো হওয়ার আগেই অবশ্য মোটর বাইকে চেপে আদি পুজো কমিটি ক্লাবের পিছনের রাস্তা দিয়ে চম্পট দেয় ওই তিন দুষ্কৃতী। গুলিবিদ্ধ সুনীলকে খড়্গপুর রেল হাসপাতালে ও উত্তমবাবুকে খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। দু’জনকেই পরে মেদিনীপুর মেডিক্যালে এবং সেখান থেকে কলকাতায় এসএসকেএম হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
ঠিকাদার থেকে রেলকর্মী, পেঁয়াজ গদির মালিক থেকে রাজনৈতিক নেতা, বারবার খড়্গপুরে দুষ্কৃতীদের নিশানা হয়েছে নানা পেশার লোকজন। খুন হয়েছেন প্রয়াত সাংসদ নারায়ণ চৌবের দুই ছেলে গৌতম চৌবে ও মানস চৌবে। একসময় খুন-জখম, গুলিচালনা ছিল খড়্গপুরের রোজকার ছবি। রেল মাফিয়াদের দাপটে তখন নিরাপত্তা উঠেছিল শিকেয়। তখন খড়্গপুরের ত্রাস ছিল বাসব রামবাবু। ক্রমে শহরে শান্তি ফেরে। তবে গত পুর-নির্বাচন পর্বে ফের দুষ্কৃতীদের দাপাদাপি শুরু হয়। একাধিক বিরোধী কাউন্সিলরের বাড়িতে গুলি চলে। তখন পুলিশের মদতে তৃণমূল মাফিয়ারাজ চালাচ্ছে বলে সরব হয়েছিল বিরোধীরা। পুরবোর্ড গঠনের পরেও গোলবাজারে এক ব্যবসায়ীকে দিনেদুপুরে খুন করা হয়েছিল। মাস চারেক সে রকম কিছু ঘটেনি। কিন্তু বিধানসভা ভোট মিটতেই ফের গুলিবিদ্ধ হলেন দু’জন।
শুক্রবার রাতে মালঞ্চর যে জায়গায় গুলি চলেছে, তা রীতিমতো জমজমাট এলাকা। সেখানে এমন একটি ঘটনা ঘটে যাওয়ায় নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। আদি পুজো কমিটি ক্লাবের সদস্য তথা রেলকর্মী কৌশিক চক্রবর্তী বলেন, “ঘটনার পরে পুলিশের সক্রিয়তা দেখছি। কিন্তু দুষ্কর্ম ঠেকাতে মাফিয়াদের চাপে রাখতে হবে পুলিশকেই। সেই কাজে ফাঁক থেকে যাচ্ছে। ভয়ে শহরবাসীও প্রতিবাদের সাহস দেখাতে পারছে না।’’ তা ছাড়া, নিশানা স্বর্ণ ব্যবসায়ী হলেও যে ভাবে একজন পথচলতি কাঠের মিস্ত্রিও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, তাতে শহরবাসীর শঙ্কা, পথেঘাটে নিশ্চিন্তে চলাফেরাই এ বার দায় হবে।
এই হামলার কারণ কী?
প্রাথমিক ভাবে পুলিশের ধারণা, ছিনতাইয়ের উদ্দেশেই দুষ্কৃতীরা ওই স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে নিশানা করেছিল। তাহলে তারা কেন গয়না ও টাকার ব্যাগ না নিয়ে চম্পট দিল, সেই প্রশ্ন উঠছে। স্থানীয়দের মতে, গুলি লাগতেই উত্তমবাবু ব্যাগটি বাড়ির দিকে ছুড়ে দিয়েছিলেন। তারপরই সুনীলের গুলি লাগে। চিৎকারে লোক জমতে শুরু করে। ফলে, ওই মুহূর্তে টাকা-গয়নার ব্যাগ নিতে পারেনি দুষ্কৃতীরা। তবে পারিবারিক বিবাদের জেরেও এই ঘটনা হতে পারে বলে পড়শিদের একাংশের মত। পৈতৃক দোকান নিয়ে বছর চোদ্দো আগে সেজদা গৌতম দাসের সঙ্গে উত্তমবাবুর অশান্তি হয়। আলাদা সোনার দোকান করেন গৌতমবাবু। সম্প্রতি পুরনো দোকানের পিছনের একটি জায়গা নিয়ে আবার মেজদা প্রদীপ দাসের সঙ্গে বিবাদে জড়ান উত্তমবাবু। যদিও উত্তমবাবু হাসপাতালে শুয়ে বারবার বলেছেন, ‘‘আমার কোনও শত্রু নেই।’’ তবে তাঁর স্ত্রী অন্নপূর্ণা দাসের বক্তব্য, ‘‘মেজদা ও সেজদার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ। প্রায়ই মেজদার সঙ্গে অশান্তি হয়।’’ মেজদা প্রদীপবাবু অবশ্য এ সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন।
খড়্গপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিষেক গুপ্তের বক্তব্য, “আমরা দু’জনকে আটক করেছি। ঘটনার পিছনে ছিনতাই না ব্যক্তিগত শত্রুতা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’’
ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।