ভবিষ্যৎ: পটাশপুরে বেবি লিগের খেলোয়াড়েরা। —নিজস্ব চিত্র
জসমিন্দরের যুগ অনেক বছরের পুরনো। ‘বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম’এর জসমিন্দর। পঞ্জাবি পরিবারের মেয়ে। ইংল্যান্ডবাসী। খেলতে চেয়েছিল ফুটবল। ইংল্যান্ডের তারকা ফুটবলার ডেভিড বেকহ্যামের মতো বাঁকানো ফ্রি কিক নেওয়ার স্বপ্ন ছিল জসমিন্দরের। কিন্তু অভিভাবকেরা তাকে ফুটবল খেলতে দিতে চান না। ভারতে এমন ঘটনা আকছার হত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে মানসিকতা বদলেছে। জঙ্গলমহলের অনেক মেয়েই এখন ফুটবল খেলছেন। কলকাতার মাঠেও খেলেন। তবে ফুটবল কর্তাদের বিস্মিত করেছে পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা মহকুমার পটাশপুর। অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন (এআইএফএফ) পরিচালিত ‘বেবি লিগ’-এ বহু মেয়ে যোগ দিয়েছে।
এআইএফএফ ছোটদের ফুটবল শেখানোর পাঠ দিচ্ছে। শুরু হয়েছে ‘বেবি লিগ’। অনূর্ধ্ব ৭, ৯, ১১ ও ১৩ বছরের ছেলে মেয়েদের নিয়ে লিগ। এআইএফএফ কর্তাদের মতে, ছোটরা সপ্তাহে ২-৩ দিন মাঠে আসুক। ফুটবল নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করুক করতে করতে ফুটবলকে ভালবাসতে শিখুক। ছোটদের মাঠে টানতে বেবি লিগের মাঠগুলোকে বেলুন ও কার্টুনের ছবি দিয়ে সাজানো হয়। পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল ও পটাশপুরে প্রতাপদিঘিতে বেবি লিগ শুরু হয়। পরে ঝাড়গ্রামের মানিকপাড়ায় শুরু হয়।
পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা ক্রীড়া সংস্থার আয়োজনে ও প্রতাপদিঘির টিকরাপাড়া রেনবো অ্যাথলেটিক ক্লাবের ব্যবস্থাপনায় টিকরাপাড়া হাইস্কুলের মাঠে গত ২৩ ডিসেম্বর থেকে বেবি লিগ শুরু হয়। এখানে অনূর্ধ্ব ৯, ১১ ও ১৩ বছর বিভাগের ছেলে মেয়েদের নিয়ে লিগ খেলা হচ্ছে। এখানে অনূর্ধ্ব ১৩ বিভাগে মোট ৮৩ জন মেয়ে যোগ দিয়েছে। তাদের আটটি দলে ভাগ করে লিগ চলছে। রাজ্যে একমাত্র পটাশপুরেই বেবি লিগে এত সংখ্যক মেয়ে যোগ দিয়েছে।
কেন পটাশপুরে মেয়েদের ফুটবলে আগ্রহ বেশি? রেনবো অ্যাথলেটিক ক্লাবের কর্তা স্বপন মাইতি জানান, তাঁরা এলাকার খেলার মাঠগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন। ক্লাব ঠিক করে, প্রতি বছর ‘দিবারাত্রি’ ফুটবল প্রতিযোগিতা করা হবে। ছেলেদের ফুটবল প্রতিযোগিতার মাঝে মেয়েদের প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হবে। ২০১৬, ২০১৭ সালে মেয়েদের প্রদর্শনী ম্যাচ দেখে এলাকার মেয়ে ও অভিভাবকদের ফুটবল খেলায় আগ্রহ বাড়ে। ক্লাবের উদ্যোগে পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়ি থেকে ফুটবল প্রশিক্ষক সাইয়ের প্রাক্তন খেলোয়াড়, গোবিন্দ সরেনের নেতৃত্বে ১০-১২ জন মেয়েকে নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণ শিবিরে মেয়েদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ‘বাগমারি নারীকল্যাণ শিক্ষা সদন’এর প্রধান শিক্ষিকা সুতপা মাইতির কাছে যান ক্লাবকর্তারা। প্রধান শিক্ষিকা ছাত্রীদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেন। এতে প্রায় ১৫০ জন অভিভাবক মেয়েদের প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠান। জেলা ক্রীড়া সংস্থা মেয়েদের ছোট বয়স থেকেই সঠিকভাবে ফুটবল প্রশিক্ষণ দেওয়ার চিন্তাভাবনা শুরু করেন। তাই প্রতাপদিঘির ফুটবলার মিলন বেরা ও শুভাশিস রায়চৌধুরীকে ‘গ্রাসরুট লেভেল কোচেস কোচিং’ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
এরপর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েদের ফুটবল খেলার প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করে রেনবো অ্যাথলেটিক ক্লাব। প্রতাপদিঘির পরিহারপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মঙ্গলপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কচিকাঁচাদের ফুটবল প্রশিক্ষণের জন্য প্রতি শনিবার কোচ মিলন বেরা ও শুভাশিস রায়চৌধুরীকে পাঠানো হয়। কয়েক মাসের মধ্যেই ফল মেলে। তা দেখে ৫-৬ কিলোমিটার দূরের খড়ইগঞ্জ কৈলাসচন্দ্র প্রাথমিক বিদ্যালয়, মংরাজ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও গোবর্ধনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা ফুটবলে আগ্রহী হয়। বেবি লিগ শুরু হলে বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েরা এবং বাগমারি নারীকল্যাণ শিক্ষাসদনের মেয়েরা যোগ দেয়। এআইএফএফ ছেলে মেয়েদের নাম নথিভুক্ত করে। ২৩ ডিসেম্বর থেকে প্রতাপদিঘির টিকরাপাড়া হাইস্কুলের মাঠে প্রতি রবিবার দিনভর বিভিন্ন বয়সের ছেলে মেয়েদের লিগ খেলা হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় ২৫০ ছেলে মেয়ে ফুটবল খেলছে। এদের মধ্যে ১১৫ জন মেয়ে যোগ দিয়েছে। অনূর্ধ্ব ১৩ বিভাগে ৮৩ জন মেয়ে যোগ দিয়েছে। অনূর্ধ্ব ১৩ বছরের দলে খেলছে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সোনালি দাস। সোনালি জানায়, ফুটবল খেলতে তার খুব ভাল লাগে। সে বড় হয়ে রাজ্যস্তরে ফুটবল খেলতে চায়।
গত ৮ মার্চ ছিল বিশ্ব নারী দিবস। মেয়েদের ফুটবলে উৎসাহ বাড়াতে এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (এএফসি) ৬-১০ মার্চ দেশে ‘এএফসি উইমেন্স ডে ফুটবল সেলিব্রেশন’ করে। ফুটবল খেলার উপকারিতা বিষয়ে মেয়েদের জানানো হয়। ভাল ফুটবলার হতে পারলে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে বোঝানো হয়। মেয়েদের জার্সি-সহ খেলার সরঞ্জাম তুলে দেওয়া হয়। পটাশপুরেও গত ১০ মার্চ পালিত হয় ‘ফুটবল সেলিব্রেশন’। উপস্থিত ছিলেন এআইএফএফ-এর ফুটবল ডেভেলপমেন্ট অফিসার উষ্ণীষ ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘পটাশপুরে এত মেয়ের ফুটবলে যোগদানের কথা শুনেই অবাক হয়েছিলাম। তাই ওদের সঙ্গে দেখা করতে এলাম। প্রথমেই ওদের অভিভাবকদের ধন্যবাদ জানাব। তাঁরা মেয়েদের মাঠে পাঠাচ্ছেন। এভাবে মেয়েরা যদি ফুটবল খেলাটা চালিয়ে যায়। তাহলে ভবিষ্যতে ওরা অনেক সুযোগ পাবে।’’
বেবি লিগের মাঠে পরিহারপুরের প্রধান শিক্ষিকা প্রণতি দাস ও মঙ্গলপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুভাষ দাস মাঠে উপস্থিত থাকেন। প্রণতি বললেন, ‘‘এখনকার বেশির ভাগ পরিবারেই একটি করে সন্তান। বাড়িতে খেলার সাথী কম। তাই বিদ্যালয়ে বাচ্চাদের খেলার সুযোগ করে দিই। ওদের নিয়ে মাঠে যাই।’’ রেনবো ক্লাবের কর্তা স্বপন মাইতি বলেন, ‘‘ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের মাঠে সাইয়ের প্রাথমিক বাছাই শিবির হয়েছিল। কলকাতায় অন্তিম বাছাই শিবিরে এলাকার ছেলে অর্কদীপ নন্দ গোস্বামী অনূর্ধ্ব ১৫ বিভাগে পাশ করেছে। আশা করি ভবিষ্যতে আমাদের এখান থেকে অনেক মেয়েও জেলার নাম উজ্জ্বল করবে।’’ পূর্ব মেদিনীপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ সম্পাদক বিপ্লব চক্রবর্তী বলেন, ‘‘প্রতাপদিঘির মেয়েরা খুব ভাল ফুটবল খেলছে। ওই এলাকায় বেবি লিগেও মেয়েদের যোগদান আমাদের উৎসাহিত করেছে।’’
পটাশপুরের জসমিন্দররা কি প্রথম থেকেই পরিবারের সমর্থন পেয়েছে? অকপটে না বললেন এক অভিভাবক, শম্পা চট্টোপাধ্যায়। বললেন ‘‘প্রথমে বাচ্চাকে ফুটবল খেলায় ছাড়তে ভয় পেতাম।’’ ভয়কে জয় করলেন কী ভাবে? শম্পা বললেন, ‘‘বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা দায়িত্ব নিয়ে প্রতি রবিবার বেবি লিগের খেলার মাঠে নিয়ে যান। তাই আমাদের কোনও চিন্তা থাকে না।’’