উড়ালপুল নিয়ে ভয় বাসা বাঁধছে জেলাতেও

ঝাড়গ্রাম উড়ালপুলের তলায় নিত্যদিন সব্জি বেচেন কমলা মাহাতো। বৃহস্পতিবার দুপুরে টিভির খবরে বিবেকানন্দ উড়াল সেতু ভেঙে পড়ার ছবি দেখার পরে অজানা একটা ভয় চেপে বসেছে।

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত ও আনন্দ মণ্ডল

ঝাড়গ্রাম ও তমলুক শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৬ ০১:২৬
Share:

ঝাড়গ্রাম উড়ালপুলের তলায় বসেছে বাজার (বাঁ দিকে)। মেচেদায় ৪১ নম্বর জাতীয় সড়কের উড়ালপুলের নীচে গাড়ি রাখার জায়গা (ডান দিকে) ছবি: দেবরাজ ঘোষ ও পার্থপ্রতিম দাস।

ঝাড়গ্রাম উড়ালপুলের তলায় নিত্যদিন সব্জি বেচেন কমলা মাহাতো। বৃহস্পতিবার দুপুরে টিভির খবরে বিবেকানন্দ উড়াল সেতু ভেঙে পড়ার ছবি দেখার পরে অজানা একটা ভয় চেপে বসেছে।

Advertisement

বিকেলে সব্জির পসরা নিয়ে বিক্রিবাটা করার সময় কমলাদেবী বলেন, “জানি না আমাদের অদৃষ্টে কী লেখা আছে!” আদতে লালগড়ের শালুকা গ্রামের বাসিন্দা কমলাদেবী এখন সপরিবারে ঝাড়গ্রাম শহরে থাকেন। আড়তদারদের থেকে সব্জি কিনে নিয়ে উড়ালপুলের তলায় বিক্রিবাটা করেন। কিন্তু পোস্তার ঘটনার পরে আর নিশ্চিন্তে থাকতে পারছেন না কমলাদেবীর মতো অনেকেই। যাঁদের রুজিরুটি জড়িয়ে রয়েছে ঝাড়গ্রাম উড়ালপুলের তলায়। আর এক সব্জি বিক্রেতা মঙ্গল সাউ বলেন, “ভয় তো করছেই। কিন্তু সংসার চালানোর জন্য ব্যবসা তো আর বন্ধ করতে পারব না।”

সেতুর তলায় টেবিল পেতে ধূপ জ্বেলে লটারির টিকিট বিক্রি করছিলেন সুরেশ ধাড়া। এই যুবকের কথায়, “টিভিতে ধ্বংসের ছবি দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছি। যদিও ঝাড়গ্রামের উড়ালপুলটি খুব মজবুত ভাবে তৈরি হতে দেখেছি। তবুও বিপদ তো আর বলে আসে না।” উড়ালপুলের তলায় বসে জুতো সেলাইয়ের কাজ করেন বঙ্কিম রুইদাস। তিনি বললেন, “গরিব মানুষের অতশত ভাবলে চলবে না। কাজ না করলে তো না খেয়ে মরব। উড়ালপুলের তলায় ফাস্টফুড সেন্টার চালান বাসুদেব গিরি। চপ-কাটলেট-চাউমিনের দেদার খদ্দের। বাসুদেবের কথায়, “এই অস্থায়ী দোকানই পেটের ভাত জোগাচ্ছে। ভয় পেলে আমাদের চলবে না।”

Advertisement

ঝাড়গ্রাম শহরে মেন রেল ক্রসিংয়ের উপর উড়ালপুলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বাম আমলে। রেলগেটটির জন্য শহরের দু’টি প্রান্তে যাতায়াতে সমস্যা হত। প্রায়ই তুমুল যানজট হত। তৃণমূলের সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ২০১১ সালের অগস্টে উড়ালপুল তৈরির কাজ শুরু হয়। রাজ্য ও রেল দফতরের যৌথ বরাদ্দকৃত সাড়ে ১২ কোটি টাকায় রেলের তরফে টেন্ডার ডেকে ঠিকাদার নিয়োগ করে কাজটি করানো হয়। উড়ালপুলের তলায় ফাঁকা জায়গায় রোজই বসেন সব্জি ও মাছ বিক্রেতারা। ফলের ঠেলাগাড়ি, লটারি, মুচি, ফাস্টফুড সেন্টার সবই রয়েছে। সকাল-বিকেলে লোকজনের আনাগোনা হয় সেতুর তলায়।

ঘটনা হল, গত বছর মাঝামাঝি উড়ালপুল তৈরির শেষ হয়ে যায়। আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্বোধন না হলেও গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে যানবাহন চলাচল শুরু হয়ে যায়। তার আগেঅ অবশ্য বছর তিনেক ধরে উড়ালপুলের তলায় অস্থায়ীভাবে সব্জি ও মাছের বাজার বসছে। অস্থায়ী ভাবে নানা রুজির মানুষজন ব্যবসা করছেন। কিন্তু এখনও রেল প্রশাসনের তরফে উড়ালপুরটি রাজ্য সরকারকে হস্তান্তর করা হয়নি। উড়ালপুলটি শহরের উপর দিয়ে যাওয়া ৫ নম্বর রাজ্য সড়কের উপর তৈরি হয়েছে।

ফলে সেতুর তলায় দু’পাশে হাঁটাচলার যথেচ্ছ রাস্তা এখনও তৈরি হয়নি। রাস্তার দু’পাশের স্থায়ী দোকানপাটগুলির কিছুটা অংশ ভেঙে সেতুর তলায় দু’পাশে সমান্তরাল দু’টি রাস্তা তৈরি করার পরিকল্পনা নেওয়া হলেও ভোটের রাজনীতির জন্য তা বাস্তবায়িত হয়নি। শোনা গিয়েছিল, রাস্তা তৈরির জন্য যে সব স্থায়ী দোকানের অংশ বিশেষ ভাঙা হবে, সেই সব দোকান মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কিন্তু পুরোটাই এখন বিশ বাঁও জলে। ঝাড়গ্রাম উড়ালপুলে কোনও অঘটন ঘটলে দমকল, ক্রেন ও উদ্ধারকারী দলের ঢোকাটাই দুসাধ্য হয়ে পড়বে বলে মনে করেন স্থানীয় ব্যবসায়ীদের একাংশ।

সেতুর তলায় সব্জি বেচার ফাঁকে দীনবন্ধু পাঠক বলেন, “এই সেতুটা খুব শক্তপোক্তভাবে তৈরি হয়েছে। ওই টুকুই যা ভরসা।” ঝাড়গ্রামের পুরপ্রধান দুর্গেশ মল্লদেব বলেন, “রেলের সম্মতি পেয়ে আমরা উড়ালপুলে বাতি লাগিয়েছি। তবে এখনও উড়ালপুলের দায়িত্ব হাতে পাইনি। কী কারণে বলতে পারব না।”

দুর্ঘটনার জেরে আতঙ্ক ছড়িয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরের মেচেদা বাজারে। ৪১ নম্বর জাতীয় সড়কের উড়ালপুলের নীচের ফাঁকা অংশ দখল করে গড়ে উঠেছে দোকান। বৃহস্পতিবার দুপুরে টিভি পর্দায় পোস্তার ভয়াবহ ওই দৃশ্য দেখার পর থেকে শিউরে উঠছেন অনেক ব্যবসায়ী।

হলদিয়া শিল্পাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগকারী ৪১ নম্বর জাতীয় সড়কের উপর প্রায় ছ’বছর আগে ওই উড়াল তৈরি করে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ। ৪১ নম্বর জাতীয় সড়ক এবং হলদিয়া-মেচেদা রাজ্য সড়কের সংযোগস্থলে মেচেদা বাজার পাঁচমাথার মোড়ে উড়ালপুলের পাশাপাশি নীচের রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করে অসংখ্য বাস, ট্যাক্সি-সহ বিভিন্ন যানবাহন। তা ছাড়াও উড়ালপুল চালুর পরেই নীচের ফাঁকা জায়গা দখল তৈরি হয় প্রায় একশোটি ছোট-বড় খাবার হোটেল, ফুল দোকান, সেলুন, স্টেশনারি থেকে ইমারতি দ্রব্যের মতো দোকান।

ব্যবসায়ী বিশ্বনাথ দাস, নন্দলাল হাজরা এ দিন বলেন, ‘‘এখানে উড়ালপুল নিয়ে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু আজকে কলকাতার দুর্ঘটনার পর থেকে বেশ ভয় লেগেছে।’’ মেচেদার বাসিন্দা পেশায় চিকিৎসক শুভজিৎ অধিকারী বলেন, ‘‘কলকাতার দুর্ঘটনা পর আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি। আমাদের এখানেও উড়ালপুলের উপর দিয়ে প্রতিদিন প্রচুর ভারী গাড়ি চলাচল করে। কত বছর হয়ে গেল উড়ালপুলের কী অবস্থা কে জানে? নিরাপত্তা খতিয়ে দেখা দরকার।’’ পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনের কর্তারা অবশ্য দায় ঝেড়ে ফেলেছেন আগেই। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক উচ্চ পদস্থ কর্তা সাফ বলেন, ‘‘জেলায় যে কয়েকটি উড়ালপুল রয়েছে তার সবগুলি জাতীয় সড়কের উপরেই। ওইসব উড়ালপুলের রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের।’’

নন্দকুমার হাইরোডের কাছে তমলুক-দিঘা রেললাইনের উপরও রয়েছে আরও একটি উড়ালপুল। এ ছাড়া, হাওড়া থেকে খড়্গপুরগামী ৬ নম্বর জাতীয় সড়কে কোলাঘাটের হলদিয়া মোড়ের কাছে এবং পাঁশকুড়ার মেচগ্রামের কাছে ঘাটাল–পাঁশকুড়া রাজ্য সড়কের উপর নতুন উড়ালপুল নির্মাণ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার কলকাতার পোস্তায় উড়ালপুল ভেঙে দুর্ঘটনার জেরে মেচেদার ওই ব্যবসায়ীরা সহ ওই এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement