স্বামীর ছবি হাতে নিহত জীবন ছেত্রীর স্ত্রী রেণু। —নিজস্ব চিত্র।
১৯৫০ সালে রাজ্যে গঠিত হয়েছিল সশস্ত্র বাহিনী ‘ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল’(ইএফআর)। মাওবাদী দমনে জঙ্গলমহলে পাঠানো হয়েছিল এই বাহিনীকেও। ২০১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শিলদায় সেই ইএফআরের ক্যাম্পে মাওবাদী হামলার অভিযোগ ওঠে। মৃত্যু হয় ২৪ জন ইএফআর জওয়ানের। দীর্ঘ অপেক্ষার পরে, মঙ্গলবার সেই ঘটনায় ২৩ জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছে মেদিনীপুর আদালত। এখন সাজার অপেক্ষা। এই আবহে মাওবাদী দমনে দোষীদের চরম শাস্তির দাবি উঠছে খড়্গপুর গ্রামীণের সালুয়ায় ইএফআরের তিনটি ব্যাটালিয়ানের সদর দফতরে।
শিলদার ঘটনায় মৃত ২৪ জন ইএফআর জওয়ানের মধ্যে ১০ জন ছিলেন সালুয়া ইএফআরের দ্বিতীয় ও বাকিরা তৃতীয় ব্যাটালিয়ানে কর্মরত। এদিন মেদিনীপুর আদালতের খবর পৌঁছনোর পরে খুশির হাওয়া দেখা যায় সালুয়ায়। সজল চোখে নিহতের ছবি হাতে স্মৃতি রোমন্থন করেছেন বিহান কাছারি, কান্তেশ্বর বাসুমাতারি, জীবন ছেত্রী, মধুকর সুব্বা, সূরজ বাহাদুর থাপা, বনিন দায়মারির পরিজনেরা। নিহতদের অধিকাংশের বাড়ি ছিল অসম, দার্জিলিং, নেপালে। পাঁচজন ছিলেন সালুয়ার স্থায়ী বাসিন্দা। ঘটনার পরে নিহত জওয়ানের পরিজনেরা এসেছিলেন। পরে তাঁদের অনেকে ফিরে যান। কয়েকজন স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে সালুয়াতেই থেকে গিয়েছেন। ধাপে-ধাপে ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন সকলেই। চালু হয়েছে পেনশন। নিহত জওয়ানের পরিবারের একজনকে ধাপে ধাপে ইএফআরে চাকরিও দেওয়া হয়েছে। এবার সাজা শোনার পালা।
ওই ঘটনায় নিহত রাইফেলম্যান মধুকর সুব্বা ছিলেন কালিম্পংয়ের বাসিন্দা। তাঁর ছেলে ঋষি সুব্বা ইএফআরে চাকরি পেয়েছিলেন। মাস কয়েক আগে অসুস্থ হয়ে ঋষিরও মৃত্যু হয়েছে। মধুকরের স্ত্রী সোনা ও বৌমা দীপিকা লামা সুব্বা এখনও ইএফআর কোয়ার্টারেই থাকেন। মঙ্গলবার সোনা সুব্বা বলেন, “এতদিন পরে যখন দোষীরা সাজা পেতে চলেছে তখন ছেলেকে হারিয়ে আরও অসহায় হয়ে পড়েছি।” অদূরেই থাকেন সেদিনের ঘটনায় নিহত আদতে অসমের বাসিন্দা কান্তেশ্বর বসুমাতারির পরিবার। তাঁর স্ত্রী পদ্মিনী বসুমাতারি বলেন, “ক্ষতিপূরণ পেয়েছি। পেনশন পেয়েছি। ২০১৬ সালে ছেলেরও ইএফআরে চাকরি হয়েছে। মেয়ের বিয়েও দিয়েছি ইএফআর জওয়ানের সঙ্গে। দোষীদের চরম শাস্তি চাই। আর যেন এমন ঘটনা না ঘটে। সরকারের উচিত মাওবাদী নিয়ন্ত্রণ করা।” নিহত জীবন ছেত্রীর ছেলে সরোজ ছেত্রীও ইএফআরে চাকরি পেয়েছেন। তাঁর কথায়, “আমরা নেপালে থাকতাম। দুই দিদি ও এক বোন। মা রেণু ছেত্রী আমাদের নিয়ে চরম অভাবে পড়েছিলেন। ২০২০ সালে আমি চাকরি পাই। আমার বাবার প্রাণ যারা কেড়ে নিয়ে আমাদের পথে বসিয়েছিল তাদের শাস্তি হোক। মাওবাদী যেন এই দুনিয়ায় না থাকে।”
এই ঘটনায় কড়া শাস্তি চাইছেন সালুয়ার সাধারণ মানুষও। সালুয়ার স্থানীয় তৃণমূল নেতা রোশন লামা বলেন, “ঘটনার পরে আমরাই নিহত ইএফআর পরিবারের ক্ষতিপূরণ, চাকরির জন্য লড়াই চালিয়েছিলাম। সব পেয়েছে পরিবার। শুধু বাকি ছিল বিচার।” সালুয়া ইএফআরে কর্মরত হাবিলদার মেজর শ্যাম থাপার কথায়, “এ বারও ১৫ ফেব্রুয়ারি শহিদ স্মরণ পালন করেছি। তার পরে অভিযুক্তরা দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ঘটনা আমাদের কাছে বড় জয়।’’ তবে শ্যাম মনে করেন, মৃত্যুর বদলা মৃত্যু নয়। তাই ফাঁসির প্রয়োজন নেই। দেশে কেন মাওবাদী বাড়ছে তার খোঁজ করে এর নিয়ন্ত্রণে কড়া পদক্ষেপ করুক সরকার।